পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তে পাওয়া তথ্য এবং আসামিদের জবানবন্দির ভিত্তিতে ত্রিশ বছর ছয় মাস আগে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে স্কুলশিক্ষিকা সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যার সচিত্র প্রতিবেদন (স্কেচ) প্রকাশ করা হয়েছে। তদন্তে জানা গেছে, সগিরা মোর্শেদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আর এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যুক্ত ছিল চার জন, তাদের অভিযুক্ত করে ১৬ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
১৯৮৯ সালে এই হত্যাকাণ্ডের পর ক্রমান্বয়ে ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করলেও হত্যার প্রকৃত কারণ ও আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার ত্রিশ বছর পর মামলার তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দায়িত্ব পাওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে এই হত্যায় জড়িত চার জনকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই।
আসামিরা হলো−নিহত সগিরার স্বামীর বড় ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০), হাসান আলীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪), শাহিনের ভাই আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) ও হত্যার কন্ট্রাক্ট নেওয়া মারুফ রেজা। তারা চার জনই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজারবাগে নিজেদের বাসার তৃতীয় তলায় স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের প্রস্তাবে ডা. হাসান আলী তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সগিরা মোর্শেদকে ভয়ভীতি ও হেনস্তা করে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে।
একই বাসার সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকেও পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়। এরপর হাসান আলী ও রেজওয়ান মিলে সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে গেছে।
১৯৮৯ সালের ২৩ জুলাই ডা. হাসান আলী নিউ ইস্কাটনের যমুনা ফার্মেসিতে পূর্বপরিচিত মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ জুলাই দিন নির্ধারণ করে তারা।
নিজের মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য রিকশাচালক ছালাম মোল্লার রিকশা ভাড়া করে সিদ্ধেশ্বরী যান সগিরা মোর্শেদ। তাকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য মারুফ রেজার সঙ্গে যায় আনাস মাহমুদ।
মৌচাক মার্কেটের সামনে মারুফ রেজার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আনাস মাহমুদের। দুজন একসঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়ে ভিকারুননিসা স্কুলের গেটের সামনে এসে ৫-৭ মিনিট অপেক্ষা করে। এরপর সেই পথে রিকশায় আসেন সগিরা মোর্শেদ।
আনাস মাহমুদ রিকশায় থাকা সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেয় মারুফ রেজাকে। এরপর দুজন মিলে সগিরা মোর্শেদের রিকশা ফলো করতে করতে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর রিকশার গতিরোধ করে আটকায় তারা।
মারুফ রেজা সগিরা মোর্শেদের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় এবং হাতে থাকা সোনার বালা ধরে টানাটানি করে। এসময় পাশে থেকে মারুফ রেজাকে সহযোগিতা করে আনাস মাহমুদ।
আনাস মাহমুদকে দেখে সগিরা মোর্শেদ চিনে ফেলেন। তিনি আনাসের দিকে আঙুল তুলে বলেন−‘আমি তোমাকে চিনি, এই তুমি তো রেজওয়ান, তুমি এখানে কেন?’
সগিরা মোর্শেদ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তল বের করে মারুফ রেজা। সগিরা মোর্শেদকে গুলি করা হয়। প্রথম গুলিটি লাগে সগিরা মোর্শেদের ডান হাতের কনুইয়ের ওপর ডান পার্শ্বে। দ্বিতীয়বার আবারও গুলি করা হয়। দ্বিতীয় গুলিটি বুকে লাগে। বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।
সগিরা মোর্শেদকে দুই রাউন্ড গুলি করার পর এর আগে ছিনিয়ে নেওয়া ব্যাগ ফেলে দিয়ে ফাঁকা আরও এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে মারুফ রেজা।
গুলি করার পর আবারও কোমরে পিস্তল গুঁজে রাখে মারুফ। এরপর মোটরসাইকেলে চড়ে মারুফ ও আনাস পালিয়ে যায়। দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখে পিছু ধাওয়া করে রিকশাচালক ছালাম মোল্লা। হাতে ইট নিয়ে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে চিৎকার করতে করতে যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি পর্যন্ত।
ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন রকিবুল হাসান রুমি নামের একজন চিকিৎসক। তিনি সগিরা মোর্শেদকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
এরপর রিকশাচালক ছালাম মোল্লা যান রমনা থানায়। সেখানে গিয়ে একজনকে গুলি করার বিষয়টি দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের জানান। রমনা থানা পুলিশ রিকশাচালকের সঙ্গে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসে।
এদিকে সগিরা মোর্শেদকে গুলি করার পর মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদ আসে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামনে। সেখানে এসে আনাসকে নামিয়ে চলে যায় মারুফ রেজা। এরপর মারুফ রেজা চলে যায় সায়েদাবাদের ‘হরর মুন্না’র কাছে, যার কাছ থেকে পিস্তলটি আনা হয়েছিল। তাকে পিস্তলটি বুঝিয়ে দেয় মারুফ।
সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পর বিচার চেয়ে তখন মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করা হয়। হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত কিনা এমন শিরোনামে একাধিক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়।