বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান হত্যার সঙ্গে জড়িত চক্রটি গত দুই মাসে একই কায়দায় ৮ জনকে খুন করেছে। সিএনজির ভেতর গলায় গামছা বা মাফলার পেঁচিয়ে হত্যার পর লাশ ফ্লাইওভার বা নির্জন কোনও রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যেত ওরা। শুধু খুনই নয়, সিএনজি চালিত অটোরিকশার যাত্রীরা ছিনতাইয়ের শিকারও হতো।
মিজানুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার তিন আসামি আদালতে রবিবার (২৬ জানুয়ারি) ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তিন আসামি হলো নুরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ বাবু ও মো. জালাল। এর আগে টঙ্গি থেকে নুরুল ইসলাম এবং গাজীপুর ও তুরাগ এলাকা থেকে বাবু ও জালালকে গ্রেফতার করা হয়।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গত ৫ জানুয়ারি মধ্যরাতে সিএনজিতে মিজানকে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশ ফেলে যাওয়া হয় সোনারগাঁও রেলক্রসিংয়ের ওপরে। সেখান থেকে রাত ১টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। এই ঘটনায় তার ভাই আরিফ হোসেন হাতিরঝিল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মিজানের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের সদর থানাধীন ছবিলপুর গ্রামে। বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজান শেওড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতো। পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীর হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ এর ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ শাখায় কাজ করতেন তিনি। নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে পরিবারকেও সে সহযোগিতা করতো। ফেব্রুয়ারিতে জাপানে যাওয়ার কথা ছিল তার।
গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছে, সে সিএনজি চালক। তবে তার মূল পেশা ছিনতাই। সেসহ আরও আট জন মিলে গড়ে তুলেছে সিএনজি কেন্দ্রিক দু’টি ভয়ঙ্কর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। রাত ৮টার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড এলাকায় চালাতো তাদের অপকর্ম।
নুরুল জানায়, গত ৫-৬ মাসে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে সে। তার সহযোগী ৫-৬ জন আছে যারা প্রায় ৩-৪ বছর ধরে ছিনতাই করছে। অনেকেই ২০০০-২৫০০ ছিনতাই করেছে। রাত ৮ থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে তার ছয়টি ছিনতাইয়ের রেকর্ড আছে।
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া গেছে চারটি লাশ। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা বা মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্ণকারকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় কুড়িল ফ্লাইওভারে। ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে উঠার পথের ডানপাশে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ফ্লাইওভারে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। সবক’টি হত্যার সঙ্গে এই চক্রটি জড়িত। এ সবক’টি হত্যাকাণ্ডই তারা ঘটিয়েছে বলে আদালতে স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন নুরুল ও তার দুই সহযোগী। সিএনজিতে যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দু’টি এলাকায় গত দুই মাসে তারা আরও চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নুরুল জানিয়েছে। এছাড়া ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ জন যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজি থেকে ফেলে দিয়েছে তারা। এদের মধ্যে ৮-১০ জন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে বলেও জানা গেছে।
এ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেণ তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার।