চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে দুই হলের ৮০টিরও বেশি কক্ষ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার গভীর রাতে টানা দু ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষে পক্ষে-বিপক্ষের ৪৩ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় হল দুটি থেকে ৫৯ জনকে পুলিশ আটক করলেও শেষ পর্যন্ত ৭ জনকে হাটহাজারী থানায় নিয়ে গেছে। সেখানে তাদের আটক দেখানো হয়েছে। এদিকে, সংঘর্ষ থামলেও আজ বৃহস্পতিবারও (৫ মার্চ) ক্যাম্পাসে উভয়পক্ষের মধ্যে এখনও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বিবদমান পক্ষগুলোকে নিয়ে সমাধানের জন্য রাতেই বৈঠকে বসছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ।
আটকরা হলেন- সিক্সটি নাইন গ্রুপের রসায়ন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের গোলাম শাহরিয়ার, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জোবায়ের আহমেদ নাদিম, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের মাশরুর অনিক, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আকিব জাবেদ, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের রুম্মান, হায়দার। বিজয় গ্রুপের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের জিন্নাত মজুমদার ও কনকর্ড গ্রুপের জিসান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা জানান, বুধবার (৪ মার্চ) দিবাগত রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপ সিক্সটি নাইন ও কনকর্ড পূর্ব বিবাদের জের ধরে বিজয় গ্রুপের কর্মীদের ওপর এ হামলা চালায়। ভোর অবধি এ হামলা চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। রাত তিনটার দিকে উভয় গ্রুপের ৫৯ জনকে আটক করা হয়। তাদের হাটহাজারী থানায় নিয়ে যাচাই বাছাই করে ৫২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী পরিচয়ধারী হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংগঠনের অনেকগুলো গ্রুপ-উপগ্রুপ রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান তিনটি গ্রুপ হচ্ছে সিক্সটি নাইন, কনকর্ড ও বিজয়। শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক এসব গ্রুপ হলেও নগর রাজনীতির সুস্পষ্ট প্রভাবও রয়েছে এসব গ্রুপের মধ্যে। সিক্সটি নাইন ও কনকর্ড চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু। অন্যদিকে, বিজয় গ্রুপটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
আলাওল হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, হলের ২৩৮ নম্বর কক্ষে এই ঘটনার সূত্রপাত। সেখানে থাকা বিজয় গ্রুপের কর্মী মো. আবদুল্লাহর সঙ্গে কনকর্ড গ্রুপের কর্মী আরমান হোসেনের দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া চলছিল কয়েকদিন ধরে। এ ঘটনায় গত সোমবার আব্দুল্লাহ বিজয় গ্রুপের আরেক কর্মী আবিরকে ডেকে এনে আরমানকে মারধর করেন। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে মঙ্গলবার রাতে সিক্সটি নাইনের নেতা-কর্মীদের ডেকে এনে আবিরকে মারধর করেন আরমান ।
ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী জানান, এ ঘটনা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে বুধবার বিকেলে সিক্সটি নাইনের এক কর্মীকে মারধর করেন বিজয়ের নেতা-কর্মীরা। ঘটনা জানাজানি হলে সন্ধ্যায় আবারও সংঘর্ষে জড়ায় সিক্সটি নাইন ও বিজয়। সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় বিজয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে শাহজালাল হলের সামনে অবস্থান নেয় সিক্সটি নাইন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কনকর্ড গ্রুপ। এসময় দু’পক্ষে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ এসে উভয়কে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আটক হয় চারজন। আর আহত হয় তিন গ্রুপের পাঁচ জন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার ওই ঘটনার পর রাতে সিক্সটি নাইন ও কনকর্ড গ্রুপের কর্মীরা একজোট হতে থাকে এবং রাত একটার দিকে এফ রহমান হলে ঢুকতে চাইলে ওই হলে থাকা বিজয় গ্রুপের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রথমে হলে ভাঙচুর চালিয়ে বিজয় গ্রুপের কর্মীদের হল থেকে বের করে দেয় কনকর্ড গ্রুপের নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল থেকে বিজয় গ্রুপের কর্মীরা বের হলে হলের সামনে মুখোমুখি হয় উভয় গ্রুপ। এসময় বিজয় গ্রুপ এএফ রহমান হলের ভেতরে এবং কনকর্ড গ্রুপের কর্মীরা হলের সামনে অবস্থান নিয়ে ইট-পাথর নিক্ষেপ করে। এসময় ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এসময় কনকর্ড গ্রুপের কর্মীরা এএফ রহমান হলে ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা থাকেন এমন অর্ধশতাধিক কক্ষ ভাঙচুরসহ তছনছ করে এবং হলের সামনে রাখা চারটি মোটরসাইকেল কুপিয়ে ভাঙচুর করে। অনেকগুলো রুমে লুটপাট চালিয়ে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়। হলের লাইটগুলো ভেঙে দিয়ে ভেতরে থাকা প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের গণহারে মারধর করে তারা। এ সময় দুই গ্রুপের অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হয়।
এর আগে একইভাবে সোহরাওয়ার্দী হলেও হামলা চালায় কনকর্ড গ্রুপের নেতাকর্মীরা। সেখানেও প্রতিপক্ষের বেশ কিছু কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। পরে রাত ২টার দিকে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় কনকর্ডের ৫৭ জন ও বিজয় গ্রুপের ২ জনকে আটক করে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাতভর হল ঘিরে পাহারাও দেয় পুলিশ।
বিজয় গ্রুপের এক কর্মী দাবি করেছেন, দুই হলে তাদের ৮৭টি কক্ষ ভাঙচুর ও তছনছ করেছে সিক্সটি নাইন ও কনকর্ড গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। তারা কক্ষগুলো থেকে ল্যাপটপসহ মূল্যবান বিভিন্ন জিনিস এবং টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। তারা হলের সামনে রাখা ৫-৬টি মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিজয় গ্রুপের নেতা ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস কাছে দাবি করেন, মধ্যরাতে শিবির স্টাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল টিপুর নেতৃত্বে এ নৃশংস হামলা হয়েছে। আমাদের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
এদিকে চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা ইকবাল হোসেন টিপু দাবি করেন, সন্ধ্যায় তিনটি হল থেকে বিজয় গ্রুপের কর্মীরা আমাদের (সিক্সটি নাইন ও কনকর্ড গ্রুপ) কর্মীদের বের করে দেয়। প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তাদের হলে ওঠার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। রাতে তারা দুই হলে উঠতে গেলে হামলা চালায় বিজয়ের কর্মীরা।
অপরদিকে, কনকর্ড গ্রুপের নেতা ও সাবেক সহ সভাপতি আব্দুল মালেক বলেন, হলে ভাঙচুর চালানো, বাইক ভাঙচুর করার সঙ্গে আমাদের কোনও কর্মীই জড়িত নাই। ওই হলে যারা থাকে তারাই এটা করেছে। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য এসব করে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
সংঘর্ষের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক বলেন, ভাঙচুর ও সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বলেন, বর্তমানে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আজ রাতেই বিবদমান পক্ষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বসবো। এ বৈঠকে ভিসি এবং চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার উপস্থিত থাকবেন। সেখানে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ ঘটনার মীমাংসা করা হবে।
হলগুলোতে হামলার ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির দায় কারা নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে বৈঠকে বসি, আলোচনা করি। তারপর এসব বিষয়ে বলা যাবে।