বগুড়ায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর গুজবে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। বিভিন্ন এলাকায় স্বাভাবিক মৃত্যুতেও স্থানীয়রা করোনার ভয় পাচ্ছেন। মৃত ব্যক্তির লাশের জানাজা-দাফনে ভোগান্তির পাশাপাশি নানাভাবে নাজেহাল হচ্ছেন স্বজনরা। শুধু তাই নয়, এসব ঘটনায় প্রশাসন ও গণমাধ্যম কর্মীদেরও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হয়রানি এড়াতে স্বাভাবিক মৃত্যুর জানাজা ও দাফনের খবর প্রচার করা থেকে অনেকেই বিরত থাকছেন।
গত ২৭ মার্চ শিবগঞ্জ উপজেলায় মাসুদ রানা নামে এক ব্যবসায়ী শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী মাজেদা বেগম বিভিন্ন হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে ফোন করে ও প্রতিবেশীদের ডেকে কোনও সহায়তা পাননি।
করোনা ভাইরাসের ভয়ে কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। এ অবস্থায় একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে মৃত স্বামীর লাশ ১৬ ঘণ্টার বেশি সময় পাহারা দেন মাজেদা। পরদিন ২৮ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে মৃত মাসুদ রানার নাকের সোয়াব সংগ্রহ করা হয়। আর উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ মাসুদের স্ত্রী ও সন্তানকে হোম কোয়ারেন্টিন এবং প্রতিবেশী ১০ বাড়ি লকডাউন করে।
পরে স্থানীয় প্রশাসন মাগরিবের পর পিপিই পরিহিত চার ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রামের একটি কবরস্থানে মাসুদ রানার লাশ দাফনের উদ্যোগ নেন। তবে গ্রামবাসীকে নিয়ে ময়দানহাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মেজবাউর রহমান লাশ দাফনে বাধা দেন। এরপর প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোবহানপুর বড় পুকুরিয়া পীরপল কবরস্থানে লাশ দাফনের চেষ্টা করলে সেখানেও বাধা দেওয়া হয়। পরে প্রশাসন কঠোর হলে স্থানীয়রা পিছু হটে।
তবে ৩০ মার্চ দুপুরে আইইডিসিআর থেকে আসা রিপোর্টে বলা হয়, মাসুদ রানা করোনা ভাইরাসে মারা যাননি। পরে স্থানীয় প্রশাসন মাইকিং করে তার পরিবার ও ১০ বাড়ি থেকে লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়। আর দাফনে বাধা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা মেজবাউর রহমানকে শোকজ করে উপজেলা আওয়ামী লীগ।
ঢাকার গার্মেন্টসকর্মী অসুস্থ আলপনা বেগমের শ্বশুরবাড়ি বগুড়া সদরের ছোট কুমিড়া গ্রামে। গাবতলী উপজেলার উনচুরকি গ্রামে তাদের জমিজমা ও কবরস্থান রয়েছে। পারিবারিক কারণে তার ছেলে আত্মহত্যা করেন। ওই নারী ছেলের লাশ দাফনের জন্য ৩০ মার্চ বগুড়ার দিকে রওনা হন। তবে ছোট কুমিড়া গ্রামে প্রচার হয় যে, আলপনা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তখন গ্রামের লোকজনের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা আলপনাকে তার মৃত ছেলের লাশ নিয়ে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে হটলাইনেও ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু আলপনা বেগম ছেলের লাশ নিয়ে সোজা গাবতলীর উনচুরকি গ্রামে যান। পরে ছোট কুমিড়া গ্রামের মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখা দেয়।
৩০ মার্চ সন্ধ্যার পর বগুড়া শহরের মধ্য কাটনারপাড়ার ব্যবসায়ী আমিনুর রহমানের ছেলে পৃথিবী (২৫) মারা যান। এর আগে এক হাতুড়ে চিকিৎসক তাকে ইঞ্জেকশন পুশ করেছিলেন। পৃথিবী গত শ্বাসকষ্ট-কাশি-জ্বর ও ডায়রিয়াতে ভুগছিলেন। মৃত্যুর পর করোনার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তার পরিবারের সদস্যরাও অসুস্থতার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিতে থাকেন। এতে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। পরে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা সেখানে আসেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা ওই পরিবারকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ও মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যে লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তির স্বজনরা মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় ও এলাকায় স্বাভাবিক চলাফেরা করায় এলাকাবাসীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে মঙ্গলবার বাদ জোহর পৃথিবীর লাশ দাফন হলে উত্তেজনা কমে আসে। তবে ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, করোনায় তার মৃত্যু হয়নি।
একইদিন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার কেশরতা গ্রামে দুবাই ও ঢাকা ফেরত তিন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এমন সন্দেহে গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এদের মধ্যে ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে বাড়িতে আসা দিনমজুর কাবিল উদ্দিনকে তার স্ত্রী ঘরে ঢুকতে দেননি। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শহীদুল্লাহ দেওয়ান ওই তিন ব্যক্তির পরিবারকে হোম কোয়েরেন্টিন করে লাল পতাকা টানিয়ে দেন। তবে ওই চিকিৎসক জানান, তিন ব্যক্তির মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের উপসর্গ নেই।
এদিকে করোনা আতঙ্কে জেলার বিভিন্ন স্থানে কোনও ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও প্রতিবেশীরা করোনাভাইরাসের ভয় পাচ্ছেন। তারা মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে জানাজা ও দাফনে অংশ নিচ্ছেন। সোমবার শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ায় টিঅ্যান্ডটির সাবেক কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান হৃদরোগে মারা যান। তার মৃত্যু নিয়েও এলাকায় নানা প্রশ্ন তোলা হয়। এসব কারণে মৃতব্যক্তির জানাজা ও দাফনের বিষয়ে মাইকিং কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ মারা গেলে প্রচার ছাড়াই দ্রুত লাশ দাফন করছেন স্বজনরা।
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব গুজব এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়ো হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনও সমস্যায় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।