করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসায়ীরা যেন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেওয়া প্যাকেজ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা নিতে পারেন, সে জন্য নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার (১৩ এপ্রিল ) বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতিমালাটি দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে; সেখান থেকে মূলধনবাবদ ঋণ পাওয়া-না পাওয়া নির্ভর করবে ব্যাংক ও গ্রাহক সম্পর্কের ওপর।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেন।
নীতিমালাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনও তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩১ ডিসেম্বর তারিখ ভিত্তিক কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই) ঋণস্থিতির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এক অর্থবছরে এই প্যাকেজের আওতায় চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা দিতে পারবে। যেহেতু আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় মোট তহবিলের পরিমাণ নির্ধারিত রয়েছে, এ কারণে প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ সীমার বিষয়ে এ সার্কুলার জারির ৩ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্টকে অবহিত করবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে এই সীমা বাড়াতে বা কমাতে পারবে। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত হলে সীমাতিরিক্ত ঋণের ওপর সরকার হতে ভর্তুকি পাবে না।
এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাতের উৎপাদন ও সেবা উপখাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে, ব্যবসা বা ট্রেড-ভিত্তিক মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প এ সুবিধার আওতাভুক্ত হবে। এই প্যাকেজের আওতায় উৎপাদন, সেবা ও ব্যবসা (ট্রেড) উপখাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বার্ষিক মোট ঋণের আনুপাতিক হার হবে যথাক্রমে ৫০, ৩০ ও ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে, বার্ষিক মোট ঋণের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ গ্রাম অঞ্চলে বিতরণ করতে হবে। মোট ঋণের ন্যূনতম ৭০ শতাংশ কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে এবং অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ মাঝারি শিল্প খাতে প্রদান করা যাবে। বার্ষিক মোট ঋণের ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ প্যাকেজের মেয়াদ হবে ৩ বছর। কোনও একক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ এক বছর এ প্যাকেজের আওতায় সরকার হতে ভর্তুকি পাবে।
ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা
শুধু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা এই সুবিধার আওতাভুক্ত হবেন। তবে ঋণ খেলাপিরা এই সুবিধা পাবেন না। কোনও ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কোনও ঋণ মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর, ইতোপূর্বে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলকৃত হলে এরূপ ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা পাবে না।
কুটির ও মাইক্রো শিল্পে নতুনভাবে ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদনকারী (যাদের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কোনও ঋণ নেই, তবে যারা এত দিন নিজস্ব পুঁজি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুবিধা নিতে আগ্রহী) এবং বিদ্যমান ঋণগ্রহীতা উভয়ের ক্ষেত্রেই সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক বিবরণী (ঋণ গ্রহণের সময় সর্বশেষ হিসাব বছর শেষ হওয়ার ছয় মাস অতিবাহিত না হলে পূর্ববর্তী হিসাব বছরের আর্থিক বিবরণী) অথবা বিগত বছরের (এক বা একাধিক) উৎপাদন/বিক্রি/টার্নওভারের লিখিত হিসাব থাকা সাপেক্ষে এ ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়া যাবে।
চলতি মূলধন ঋণের ব্যবহার
কেবল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমই খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে চলতি মূলধনের চাহিদার বিপরীতে এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ ব্যবহার করা যাবে।
এ প্যাকেজের আওতায় গৃহীত ঋণ দিয়ে বিদ্যমান কোনও ঋণ হিসাব সমন্বয় বা পরিশোধ করা যাবে না। বিএমআরই-সহ ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনও ব্যবসা চালুর জন্য এ ঋণ ব্যবহার করা যাবে না।
ঋণ সীমা ও মেয়াদ
ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের বিগত জানুয়ারি হতে পরবর্তী মাসসমূহের উৎপাদনের বা বিক্রয়ের নিম্নমুখীতা যথাযথভাবে নিরূপণকরত: বিগত বছরের (এক বা একাধিক) উৎপাদন/বিক্রি/টার্নওভারের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের পরিমাণ হিসাব করতে হবে।
উৎপাদন ও সেবা শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা; যারা ইতোপূর্বে ব্যাংক হতে চলতি মূলধন ঋণ নিয়েছেন—সে সব ঋণ গ্রহীতারা বিদ্যমান চলতি মূলধন ঋণ স্থিতির ৩০ শতাংশ বা সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরসহ বিগত তিন বছরের আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, গড় পরিচালন ব্যয়ের ৫০ শতাংশ- এ দুটির মধ্যে যেটি কম, সেই পরিমাণ চলতি মূলধন সুবিধা পেতে পারেন।
ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা; যারা ইতোপূর্বে ব্যাংক হতে চলতি মূলধন ঋণ নিয়েছেন, তারা সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরসহ বিগত তিন বছরের আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, গড় বার্ষিক টার্নওভার বিবেচনায় নিয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত চলতি মূলধন সুবিধা পেতে পারেন। তবে তা এক কোটি টাকার বেশি হতে পারবে না। নতুন ঋণের ক্ষেত্রে (যাদের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কোনও ঋণ নেই, তবে যারা এত দিন ধরে নিজস্ব পুঁজি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বা বিনিয়োগের সুবিধা নিতে আগ্রহী) ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় চলতি মূলধন ঋণ বা বিনিয়োগের প্রাপ্যতা সীমা নির্ধারিত হবে। তবে, উক্ত সীমা সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরসহ বিগত তিন বছরের (যদি থাকে) আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী উৎপাদন ও সেবা শিল্পের প্রাপ্যতার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অথবা বিগত বছরের (এক বা একাধিক) উৎপাদন/বিক্রি/টার্নওভারের ৫০ শতাংশ—এ দুটির মধ্যে যেটি কম সেই পরিমাণ। ট্রেডিং ব্যবসার ক্ষেত্রে ঋণ বা বিনিয়োগর পরিমাণ বার্ষিক টার্নওভারের ২৫ শাতংশ এর মধ্যে, তবে তা এক কোটি টাকার বেশি হতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ব্যবস্থায় শিল্প উদ্যোগের উৎপাদন ও টার্নওভার বিষয়ে নিয়মিত সব দলিলাদি সংরক্ষণ করবে এবং তা পর্যবেক্ষণে রাখবে। আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় কোনও ঋণ নবায়ন করা যাবে না। তবে, পরবর্তীতে ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক লেনদেন সন্তোষজনক হলে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ঋণ নীতিমালার আওতায় তা নবায়ন করতে পারে; সে ক্ষেত্রে, পরবর্তী সময়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে সুদ বা মুনাফাবাবদ কোনও ভর্তুকি দেওয়া হবে না।
ঋণের সুদ হার
এ ঋণের সুদ হার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৪ শতাংশ ঋণগ্রহীতা পরিশোধ করবেন এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করবে।
ঋণের ওপর সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপিত হলেও সরকার হতে প্রাপ্য ভর্তুকির সমপরিমাণ অর্থ ঋণগ্রহীতার দায় হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে, ঋণের সুদ (৪ শতাংশ) নিয়মানুযায়ী যথাসময়ে পরিশোধিত না হলে সমুদয় আরোপিত সুদ ঋণগ্রহীতার দায় হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, উল্লিখিত শিডিউল অব চার্জেস ছাড়া অন্য কোনও চার্জ বা ফি আরোপ করা যাবে না। কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণের ওপর অন্য কোনও প্রকার অদৃশ্য ফি আরোপ করা হলে, সে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যবস্থাপনা
এ প্যাকেজের আওতায় তফসিলি ব্যাংকের ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব ঋণ বা বিনিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ বা বিনিয়োগ অনুমোদিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে, ছোট ছোট ঋণ বা বিনিয়োগ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনে ঋণ বা বিনিয়োগে অনুমোদনের ক্ষমতা শাখাপর্যায়ে অর্পণ বা পুনর্বন্টন করা যেতে পারে। প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় চলতি মূলধন ঋণ বিতরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এর ‘এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট’-এ প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসে অনুমোদিত ও বিতরণকৃত ঋণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করবে। তথ্য যাচাই এর প্রয়োজনে ‘এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট’ সংশিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণসংক্রান্ত দলিলাদি সরবরাহের অনুরোধ করতে এবং শাখা বা মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে সংশ্লিষ্ট ঋণ প্রণোদনা আলোচ্য প্যাকেজ হতে বাতিল করা হতে পারে। ঋণ সুবিধা বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনও ভুল তথ্য সরবরাহ করা হলে উক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই প্যাকেজের আওতায় কোনও সুদ বা ভর্তুকি সুবিধা পাবে না। উপরন্তু এর জন্য বিতরণকৃত ঋণের ওপর শতাংশ হারে জরিমানা আরোপ করা হবে।