নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর উলাই’য়াহ বাংলাদেশ তাদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে টার্গেট করে ধনী পরিবারের সন্তানদের। গ্রেফতার হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যের পর পাওয়া গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সূত্র জানায়, দেশের প্রচলিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ‘খিলাফত ব্যবস্থা’ কায়েম করতে চায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটি। তাদের এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে হিযবুত তাহরীর। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা সংগঠনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় বিভিন্ন শ্রেণি-প্রেশার মানুষকে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বিচারক, সরকারের প্রশাসনিক পদে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করেছে সংগঠনটি। এসব পেশার মানুষকে সরাসরি পাওয়া নাও যেতে পারে, তাই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরকেই এখন টার্গেট হিসেবে নিয়েছে। তাদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করে ‘পরিচর্যার’ মাধ্যমে এসব পেশায় তাদের সংগঠনের কর্মীদের ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে হিযবুত তাহরীর।
‘শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হিযবুত তাহরীরের টার্গেট কেন ধনী পরিবারের সদস্যরা? সংগঠন চালাতে অর্থের প্রয়োজন। ধনী পরিবারের সন্তান যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তারা পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হাতখরচের টাকা পান। এছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামের উছিলায় পরিবার থেকে টাকা পান তারা। তারা বাবা-মায়ের কাছে চাইলে যেকোনো সময় টাকাও পান। হিযবুত তাহরীরের প্রত্যেক সদস্যকে সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। যদি ধনী পরিবারের এসব শিক্ষার্থীদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তবে আর্থিক সংকট হবে না-মূলত এমন চিন্তাধারা থেকেই ধনী পরিবারের সদস্যদের টার্গেট হিযবুত তাহরীরের।’
যেসব টার্ম ব্যবহার করে হিযবুত তাহরীর
সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শব্দের সংক্ষিপ্ত টার্ম ব্যবহার করে হিযবুত তাহরীর। এসব টার্মের মধ্যে রয়েছে- কার্পেট, লোকাল টং (এলটি), পাবলিক কমিউনিকেশন (পিসি) এবং পাবলিক ওপিনিয়ন (পিও)।
‘সদস্য সংগ্রহসহ সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য মসজিদকে টার্গেট করে হিযবুত তাহরীর। থানা সংলগ্ন মসজিদ, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাসভবন সংলগ্ন মসজিদ, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয় সংলগ্ন মসজিদ ও জনসমাগম এলাকা কেন্দ্রিক তাদের কার্যক্রম চলে; যাতে কারও সন্দেহ না হয়।’
‘মসজিদ বাছাই করার ক্ষেত্রে তারা ওই মসজিদে কার্পেট ও মসজিদের পাশে কোনো চায়ের দোকান আছে কী না তা দেখে। মসজিদের পাশে থাকা চায়ের দোকানকে হিযবুত তাহরীর লোকাল টং বা সংক্ষেপে এলটি নামে ডাকে। মসজিদ সংলগ্ন এলটি থাকলে সেটিকে সাংগঠনিক কাজে ব্যবহারের উপযোগী বলে মনে করে তারা।’
এলটি থেকে সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া
‘মসজিদ থেকে বের হয়ে চায়ের দোকানে চা পান করতে যায় তারা। সেখানে চা পান করার ফাঁকে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা শুরু করে। তাদের কোনো এক সদস্য এসব প্রসঙ্গ তুলেন। ওই কথার সঙ্গে ইসলামিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ভালো বা খারাপ মন্তব্য করেন। সেখানে থাকা সাধারণ মুসল্লি কেউ যদি তাদের সঙ্গে কথায় সায় দেন তবে তাদের টার্গেট করেন হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা। কথার ফাঁকে ওই ব্যক্তির সম্পর্কে জেনে নেন তারা।’
‘পরের দিন একই স্থানে মসজিদ থেকে বের হয়ে আবারও চা পান করতে যান হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা। সেখানে টার্গেট করা ব্যক্তিকে পেলে তার সঙ্গে আড্ডা দেন তারা। ওই ব্যক্তির মনমানসিকতা বুঝে নেন। একই কায়দায় শিক্ষার্থীদেরকেও রেকি করা হয়। মনমানসিকতা বুঝে নেওয়া হয় টার্গেট করা শিক্ষার্থীর। এ বিষয়কে তারা পাবলিক কমিউনিকেশন (পিসি) হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। টার্গেট ব্যক্তির সায় দেওয়াকে তারা পাবলিক ওপিনিয়ন (পিও) হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। এসব বিষয়ে তারা নিয়মিত রিপোর্টও পাঠায়। এসব রিপোর্টে টার্গেট করা ব্যক্তির সম্পর্কে মতামত থাকে।’
যোগাযোগের মাধ্যম ‘জাস্ট টক’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি ও ধরা পড়া এড়াতে হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে অ্যাপস ‘জাস্ট টক’। এই অ্যাপস ব্যবহার করলে তাদের কথোপকথনের কোনো রেকর্ড থাকে না।
হিযবুত তাহরীরের নেতা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ নতুন সদস্যদের মোবাইলে ‘জাস্ট টক’ অ্যাপস ডাউনলোড করে তা চালানোর কৌশল শিখিয়ে দেন।
জানতে চাইলে মামলার সুপারভাইজিং কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. মঈনুল ইসলাম বলেন, হিযবুত তাহরীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য আমরা খতিয়ে দেখছি।
মো. মঈনুল ইসলাম বলেন, হিযবুত তাহরীর শিক্ষার্থী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে তাদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের সদস্য করার ক্ষেত্রে ধনী পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে থাকে। সংগঠন চালাতে অর্থের প্রয়োজন। ধনী পরিবারের সন্তান যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তারা পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হাতখরচের টাকা পান। যদি ধনী পরিবারের এসব শিক্ষার্থীদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তবে সংগঠনে আর্থিক সংকট হবে না- এমন চিন্তাধারা থেকেই ধনী পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে হিযবুত তাহরীর।
গত ২২ নভেম্বর নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হিযবুত তাহরীরের আঞ্চলিক প্রধান আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলমসহ ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সংগঠনের ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা, হিযবুত তাহরীরের তথ্যসহ দুইটি ল্যাপটপ ও ডিভাইস, একটি মোটর সাইকেল, প্রচারপত্র, গঠনতন্ত্র, ট্রেনিং ম্যানুয়েল উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের কাছ থেকে আরও ১০ জনের নাম পাওয়া যায়। পরে ২৩ নভেম্বর কোতোয়ালী থানায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে পুলিশ।
হিযবুত তাহরীরের মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে মাঠ পর্যায়ে হিযবুত তাহরীর তিনটি সাংগঠনিক উইংয়ে ভাগ হয়ে কাজ করে। এই তিন উইংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ, আফজাল হোসেন আতিক প্রকাশ আকাশ ও তাহমিদ সুফিয়ান। তিনটি উইং আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলমের অধীনে কাজ করতো।