চট্টগ্রাম: মোহাম্মদ ইউসুফ মিয়া। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই।
রোববার ঠিক সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্ত। ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে আসছিলেন ট্রেন দেখতে।
চট্টগ্রাম থেকে পর্যটননগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনটি তখন রামু স্টেশনে অপেক্ষা করছিল।
ইউসুফ মিয়া এসেই হতবাক, তাকিয়েছিলেন ট্রেনের দিকে।
তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আর পাকিস্তানীরা যা পারেনি- শেখের বেটি তা করে দেখিয়েছেন।
যা কথা দিয়েছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। নিজ চোখে ট্রেন দেখলাম।
১৯৩১ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। যদিও পরে দোহাজারী পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয় এই রেললাইন। এতটুকুতেই আটকে ছিল কক্সবাজারের মানুষের রেল যোগাযোগের স্বপ্ন। ৯২ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের সঙ্গে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি কথা রেখেছেন। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের। তাই তারা আজ উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত।
প্রথমবারের মতো রোববার (৫ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে ট্রেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এটিই কক্সবাজারে যাওয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রথম ট্রেন। আটটি কোচ ও একটি ইঞ্জিনের জিআইবিআর স্পেশাল ট্রেনে করে সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের কারিগরি তদারকি করেন। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ষোলশহর স্টেশন, জ্বালানিহাট রেলস্টেশন, সংস্কার করা শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু সফলভাবে পার হয় ট্রেনটি। এরপর পটিয়া, চন্দনাইশ এলাকা পার হয়ে দোহাজারী স্টেশনে ট্রেনটি থামে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেখানে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। দোহাজারী থেকে ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। দোহাজারী স্টেশন থেকে স্বপ্নের এই ট্রেন সাতকানিয়া, লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের হাতির করিডোর পরিদর্শন করেন সংশ্লিষ্টরা। সেখানে মানুষের বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। এরপর চকরিয়া। সেখানেও রেললাইনের দুইপাশে হাজারো মানুষ স্বপ্নের ট্রেন দেখতে ছুটে আসেন।
চকরিয়ায় ট্রেন থামতেই অনেকে ছুঁয়ে দেখছেন। আবার কেউ সেলফি তুলেছেন। গ্রামের মানুষ দূর থেকে এ মাহেন্দ্রক্ষণের ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে রেখেছেন। সেখান থেকে ট্রেনটি রামু স্টেশনে আসতেই হাজারো উৎসুক জনতা ট্রেনে উঠে পড়েন। আধা ঘণ্টার চেষ্টায় তাদের ট্রেন থেকে নামান রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর সন্ধ্যা নামতেই কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন। সেখানে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা হাতে হাজারো জনতা ট্রেনটি বরণ করতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আসা রেলওয়ের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের ঝিলংঝা ইউনিয়নের বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, কক্সবাজারে ট্রেন আসবে শুনেছি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আজ যখন সত্যি সত্যি চোখের সামনে ট্রেন দেখলাম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম। পরে ট্রেনটি ধরে দেখছি। সেখানে উঠে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছি।
রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের রেল পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদ বলেন, দোহাজারি স্টেশন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নবনির্মিত ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। রেললাইনে কোনও ধরনের ত্রুটি নেই। তবে লোকবল নিয়োগসহ কয়েকটি কারণে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করতে আরও সময় লাগতে পারে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগিন বলেন, শেষ মূহুর্তের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক এসে দেখলেন। কোনও ত্রুটি পাননি। ট্রেনটি নিরাপদে কক্সবাজারে এসে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পর যেকোনও সময় বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে।
সফলভাবে কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছার পর ট্রেনটি কিছুক্ষণ বিরতি শেষে পুনরায় ফিরতে শুরু করে চট্টগ্রামের পথে। এর মধ্য দিয়ে কক্সবাজারের মানুষের বহু বছরের আক্ষেপ ঘুচলো। ফিরতি পথে শামসুর রাহমানের কবিতা উঠে এলো এক সংবাদকর্মীর কণ্ঠে- ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই। ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই?