করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিভিন্ন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। গণপরিবহন ও জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শও দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দেশের গণপরিবহনগুলোতে ভাইরাসটি প্রতিরোধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমলেও এখনও গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে কোথাও জীবাণুনাশক স্প্রে করতে দেখা যায়নি। ফলে গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সচেতনতা বৃদ্ধিতে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কিছু লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু তা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে না বলে মনে করছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কারও হাঁচি বা কাশিতে থাকা জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ লেগেছে এমন কোনও বস্তু স্পর্শের মাধ্যমেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির দুই মিটারের মধ্যে থাকা অন্য ব্যক্তিকেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
এই অবস্থায় করোনার সংক্রমণ রোধে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘এ অবস্থায় গণপরিবহন ব্যবহার না করা ভালো। কারণ গণপরিবহনে মানুষের সমাগম বেশি। মানুষের সমাগম থেকে এই রোগ ছড়িয়ে যেতে পারে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণপরিবহন জীবাণুমুক্ত করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দেশে সেই ব্যবস্থা নেই। গত কয়েকদিন নগরীর বেশ কয়েকটি বাস টার্মিনাল ঘুরে কোথাও করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক প্রতিরোধক ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি। যাত্রীদের মধ্যেও সচেতনতা দেখা যায়নি। তবে কেউ কেউ শুধু মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন। পরিবহনগুলো তাদের আসনের বাইরেও দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গণপরিবহন ব্যবহার সংক্রান্ত বিশেষ সতর্কতা প্রচারের পাশাপাশি গণপরিবহনকে জীবাণুমুক্ত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। বাস টার্মিনাল ও বাস স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চ-টার্মিনাল ও লঞ্চ ঘাটের পাশাপাশি আকাশপথের সব যাত্রীদের জন্য থার্মাল স্ক্যানার বসিয়ে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করেন। তাদের পক্ষে গণপরিবহনে যাতায়াত বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিনিয়ত গণপরিবহনগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। প্রতিটি নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ থেকে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানোর সময় থার্মাল স্ক্যানার মেশিন দ্বারা স্ক্যানিং করে যাত্রী ওঠানো উচিত। প্রতিটি ট্রিপ শেষে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত পরিবহন জীবাণুনাশক স্প্রে দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাসে আসনবিহীন যাত্রী বহন বন্ধ করতে হবে। ভাইরাস প্রতিরোধে রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলে যাত্রীর হেলমেট ব্যবহার আপাতত বন্ধ রাখা যেতে পারে।’
বিদেশফেরত যাত্রীদের বিমানবন্দর থেকে হাসপাতাল অথবা আশকোনা হজক্যাম্প থেকে বাড়ি পাঠাতে নির্দিষ্ট যানবাহন ব্যবহার করা এবং এসব যানবাহন সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখতে স্প্রে ব্যবহার করার অনুরোধ করেন তিনি।
এছাড়া আন্তঃজেলা দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী এসি-ননএসি বাসে যাত্রী ওঠানোর আগে ও নামানোর পরে জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার করা, এসি বাসের যাত্রীদের ব্যবহৃত কম্বল ও সিটকভার প্রতিদিন পরিবর্তন করে পরিষ্কার করা, চালক-হেলপারদের সেফটি ইউনিফরম ব্যবহার করা, প্রতিটি ট্রিপ শেষে তাদের সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত-মুখ পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য গণপরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি বাসে যাত্রী চলাচলে সতর্ক করা হচ্ছে। প্রতিটি বাস মালিককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের এখন প্রতিটি বাস জীবাণুমুক্ত করে যাত্রী পরিবহন করতে বলা হবে। প্রয়োজনে আন্তঃজেলা যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। আমরা প্রতিটি টার্মিনালে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছি। পরিবহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মালিকদের নির্দেশ দিয়েছি। সরকার যদি পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে আমরা সেই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৪ মার্চ আমাদের কার্যকরী পরিষদের এক সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এগুলো হচ্ছে−করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সায়েদাবাদ, গুলিস্তান-টিবিসি রোড, ফুলবাড়িয়া ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং প্রত্যেকটি গাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। দূরপাল্লার গাড়ির টিকিট কাউন্টারে টিস্যু পেপার এবং হেক্সাজল বা সেনিটাইজেশন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক টার্মিনালে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে লিফলেট বিতরণ করতে হবে। পরিবহন মালিকদের এই সিদ্ধান্ত পালন করার জন্য বলা হয়েছে।’
শুক্রবার (২০ মার্চ) সকালে নগরীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, কোনও পরিবহনই মালিক সমিতির নির্দেশনা মানছে না। অনেক পরিবহন শ্রমিক সমিতি নির্দেশনার বিষয়ে জানেই না। এছাড়া টার্মিনাল ও বাস কাউন্টারগুলোতে ব্যবহৃত পাবলিক টয়লেটগুলোতেও জীবাণুনাশক কোনও স্যানিটাইজার দেওয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে অনাবিল পরিবহনের চালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন শতশত যাত্রী পরিবহন করি। কয়জনকে আমরা সচেতন করবো। কতবার বাস পরিষ্কার করবো? মালিকরা তো আমাদের এমন বরাদ্দ দেয় না। তাছাড়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারও বাজারে পাওয়া যায় না। দাম অনেক বেশি। আসলে সরকারের উচিত এগুলো বিনা পয়সায় সরবরাহ করা।’
নাজমুল ইসলাম নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা শুধু মিডিয়ায় সরকারের মন্ত্রী ও পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন ঘোষণা দেখতে পাই। কিন্তু সেসব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। মালিক সমিতি যেসব ঘোষণা দিয়েছে, কোনও মালিকই তা পালন করেন না। সরকারও উদাসীন। কিন্তু গণপরিবহন পরিহার করার কোনও উপায় নেই, ঝুঁকি নিয়েই ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘বিনা প্রয়োজনে যেন কেউ গণপরিবহন ব্যবহার না করে, সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্টপেজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। প্রতিটি নির্দিষ্ট বাস স্টপেজে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানোর সময় থার্মাল স্ক্যানার মেশিন দ্বারা স্ক্যানিং করা এবং প্রতিটি ট্রিপ শেষে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত পরিবহন জীবাণুনাশক স্প্রে দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে।’
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহসহ দেশের সব মহাসড়কের বাসের যাত্রীদের যাত্রা বিরতি দেওয়া রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে শতাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেসব রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির বাস বিরতি নিয়ে থাকে। ফলে কয়েক শতাধিক যাত্রী একত্রে এসব রেস্টুরেন্টের গণশৌচাগার ব্যবহার, হোটেলে নাশতা ও খাবার গ্রহণ করে থাকেন। ফলে এই বিরতি এসব স্থানেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে।’