দুবাই বসে পুরানো ঢাকার স্বামীবাগের ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করেছিল এক জঙ্গি। সেই অনুযায়ী অনুসারীদের পাঠিয়েছিল সেই ইসকন মন্দির রেকি করতে। নাশকতার জন্য অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে বোমা তৈরির উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। এসব করতে গিয়ে দুবাই পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয় সে। সাত মাস জেলে থাকার পর দুবাই পুলিশ তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশে।
দেশে এসেও জঙ্গি হামলার ছক কষছিল। কিন্তু তার আগেই কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গ্রেফতার করে তাকে। গ্রেফতার হওয়া ওই যুবকের নাম আবু কায়সার ওরফে রনি। সে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের একটি সেলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতো। বর্তমানে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আবু কায়সার রনি দুবাইয়ে বসে আনসার আল ইসলামকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। একইসঙ্গে সে তার অনুসারীদের মাধ্যমে ঢাকায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল। আনসার আল ইসলামের এই সেলের সদস্যদের মধ্যে ৮ জনকে এর আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সর্বশেষ সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করা রনিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ‘এই সেলে আরও কয়েকজন রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার কাছ থেকে আনসার আল ইসলামের সামরিক প্রধান বহিষ্কৃত মেজর জিয়া সম্পর্কেও তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।’
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতার হওয়া রনি ২০১৮ সালে দুবাই যায়। দুবাই থাকা অবস্থায় ওসমান গণি নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। দুবাইয়ে বসেই সে টেলিগ্রাম ও অন্যান্য নেটওয়ার্কিং অ্যাপসের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে গত বছর দুবাই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ৭ মাস কারাভোগের পর তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে ফিরে এসে সে পুনরায় সংগঠনের সদস্যদের সংগঠিত করে নাশকতা চালাতে কাজ শুরু করে। আবু কায়সার রনির নির্দেশেই আনসার আল-ইসলামের একটি সেলের সদস্যরা কথিত জিহাদের উদ্দেশ্যে ঢাকার ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে সিটিটিসির একটি ইউনিট আনসার আল ইসলামের এই সেলের সদস্যদের ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনার বিষয়টি জানতে পারে। পরবর্তীতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর স্বামীবাগ এলাকা থেকে মামুন, রাইসুল ও সারোয়ার নামে তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই আবু কায়সার রনির নির্দেশে ইসকন মন্দিরে হামলার জন্য রেকি করার কথা স্বীকার করে। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, মামুন জবানবন্দিতে আবু কায়সার রনিকে তাদের সেল প্রধান বা দলনেতা হিসেবে উল্লেখ করে। এরপর থেকেই তারা রনিকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা করে আসছিলেন। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া মামুনও এই গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ করতো। মামুন বছর কয়েক আগে পর্তুগাল হয়ে ফ্রান্সে গিয়েছিল। গত বছরের ১৫ নভেম্বর সে জঙ্গি হামলার উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু হামলার জন্য রেকি করতে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, এই গ্রুপের অন্যতম আরেক সদস্য হলো নাজমুল ওরফে উসমান গনি ওরফে আবু আইয়ুব আল আনসারী। ২০১৮ সালে উসমান গণির নেতৃত্বেই জঙ্গিবাদবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণ করায় চলচ্চিত্র নির্মাতা খিজির হায়াত খানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই সময় উসমান গণির দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হলেও সে দীর্ঘদিন ধরে পলাতক।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, উসমান গণিকে ধরতে পারলে এই সেলের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
আলিবাবা’র মাধ্যমে বিস্ফোরক সংগ্রহের চেষ্টা
আনসার আল ইসলামের এই সেলটি বিশ্বখ্যাত অনলাইন মার্কেটপ্লেস আলিবাবা ডটকমের মাধ্যমে বিস্ফোরকদ্রব্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল।
গত নভেম্বরে গ্রেফতার হওয়া মামুন তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, আবু কায়সার রনি তাকে বোমা তৈরির জন্য পটাসিয়াম নাইট্রেট সংগ্রহ করতে বলে। ফ্রান্সে অবস্থানকালে সে রনির নির্দেশ মতো অনলাইন মার্কেটপ্লেস আলিবাবা ডটকম থেকে দশ মেট্রিক টন পটাশিয়াম নাইট্রেট অর্ডার দিয়েছিল। বিস্ফোরক কেনার জন্য ডলারের মাধ্যমে অগ্রিম পরিশোধও করেছিল। কিন্তু বিশেষ ঝামেলার কারণে ওই বিস্ফোরক উপাদান তারা সংগ্রহ করতে পারেনি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এত পরিমাণ পটাশিয়াম নাইট্রেট অর্ডার দেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মামুনের ওপর নজরদারি শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে মামুন ফ্রান্স থেকে আউটপাস নিয়ে দেশে চলে আসে। দেশে তারা ইসকন মন্দিরে হামলার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছিল।
ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ
আদালতে দেওয়া মামুনের স্বীকারোক্তি এবং সদ্য গ্রেফতার হওয়া আবু কায়সার রনি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বিস্ফোরক উপাদান ক্রয় এবং সাংগঠনিক কাজে ব্যয়ের জন্য তারা ক্রিপ্টোকারেন্সির (এক ধরণের ডিজিটাল সাংকেতিক মুদ্রা) মাধ্যমে সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। এসব কারেন্সি সংগ্রহ করে পেপাল একাউন্টের মাধ্যমে তা সরাসরি ডলার, ইউরো বা টাকায় রূপান্তরিত করে সংগঠনের কাজে ব্যয় করতো।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, এই গ্রুপের সদস্যরা টেলিগ্রাম ও অন্যান্য অনলাইন চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করেছে। বিভিন্ন নামে একাধিক চ্যাট গ্রুপ পরিচালনা করতো তারা। আনসার আল ইসলামের এই সেলের তহবিলে যারা অর্থের যোগান দিয়েছে তাদের একটি তালিকাও পেয়েছেন তারা। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব চ্যাট গ্রুপের নাম ও ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করতে রাজি হননি।
সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা জানান, এই সেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।