ঢাকা: আগামীকাল বুধবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে খুলনা থেকে মংলা এবং আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যৌথভাবে প্রকল্প দুটির উদ্বোধন করবেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মংলা হলেও সরাসরি ছিল না রেলযোগ। ফলে সড়ক পথে দীর্ঘ সময়ে ও ব্যয়বহুল সড়ক পথে পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো।
দ্রুততম সময়ে এবং কম খরচে পণ্য পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এ রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে। একইসঙ্গে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের উদ্বোধন হওয়ায় রাজধানীতে অতি সহজেই পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে ভারত, নেপাল ও ভুটান যে বাংলাদেশের মংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সেটার পণ্য পরিবহনও হবে এ রেলপথে।
এ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, কাল(১ নভেম্বর) ১১ টায় এই রেলপথের উদ্বোধন হবে।
তবে কবে থেকে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলবে তা এখনো জানাতে পারেনি তিনি। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মোংলা রেললাইনের নির্মাণকাজ তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ১৩ বছরেও হয়নি। পাঁচ দফা সময় বেড়ে চলতি সেপ্টেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটিও সম্ভব হয়নি। পরে নভেম্বরের ৯ তারিখ উদ্বোধনের ঘোষণা করা হয়।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সরকার খুলনা-মোংলা রেলসংযোগ প্রকল্পের প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিলো ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বরে আর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে।
কিন্তু কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় প্রথম দফায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বর, পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় মেয়াদ বাড়ানো হয় চতুর্থ দফায়।
এরপর মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারপরও কাজ শেষ করতে না পারায় পঞ্চম ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হয়েছে।
তবে এবার মূল নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা ছিলো চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। বাকি সময় অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ হিসেবে ধরা আছে।
আর ৫ দফা মেয়াদ বাড়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
রেলওয়ে বলছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথে আরামদায়ক ভ্রমণের সুব্যবস্থা করা। রেলওয়ের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
সেভেন সিস্টার্সের সাঙ্গে সংযোগ ঘটছে বাংলাদেশ রেলওয়ের
খুলনা-মংলা রেলপথের মতো আগামীকাল বাংলাদেশ ও ভরতের দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন আখাউড়া-আগরতলা রেলপথও। এর মধ্যে দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের ৭ রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের রেলপথের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে।
এই রেলপথটি চালু হওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বের ৭ রাজ্যের বাণিজ্যের পরিধি বিস্তৃত হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্য আগরতলা থেকে সড়কপথে সরবরাহ হয় পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে, যেটা এখন স্বল্প খরচে রেলপথের মাধ্যমে হবে।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কেবল বাংলাদেশের রেল সংযোগ ছিলো। একইসঙ্গে আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরীণ রেল সংযোগে আসতে যাচ্ছে বিপ্লব।
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথটি চালু হলে কলকাতার সঙ্গে আগরতলার দূরত্ব কমছে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার। প্রথমে এই রেলপথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করলেও কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলও।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আজিজুল হক বলেন, রেলপথে পণ্য পরিবহন অনেক বেশি নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বিস্তৃত হবে। যখন আমদানি খরচ কম হবে, তখন ভোক্তা পর্যায়ে কম মূল্যে পণ্য পৌঁছাতে পারায় বাণিজ্য বাড়বে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এতে আমরা খুব আনন্দিত।
স্থানীয় বাসিন্দারা আশা প্রকাশ করছেন, এই রেলপথ নির্মাণ হওয়ার এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে বেকারত্ব দূর হবে। সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মিয়া বলেন, আগামীকাল ১ নভেম্বর দুদেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এই রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এ রেলপথ চালু হলে পণ্য পরিবহন সহজ হওয়ায় দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
এ রেলপথ দিয়ে দুদেশের মধ্যে প্রথমে পণ্যবাহী এবং পরে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মিয়া।
যদিও এখন পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের দিনক্ষণ ঠিক হয়নি বলে জানান রেলওয়ের এ কর্মকর্তা।
তবে রেলওয়ের অন্য একটি সূত্রে বলছে, আগামী এক মাসের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করতে চেষ্টা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেল সূত্র জানিয়েছে, এই রেলপথে ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তবে, বাঁক বেশি থাকায় নিরাপত্তা বিবেচনায় পুরো গতিতে ট্রেন চালানো নাও হতে পারে।
অন্যদিকে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হলেও ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ভবন এবং প্ল্যাটফর্মের ফিনিশিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া ভারতীয় অংশের নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা রেলস্টেশন পর্যন্ত রেলপথ তৈরির কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেজন্য এখন নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত চলবে ট্রেন। পরবর্তীতে কাজ হলে আগরতলা রেলস্টেশন পর্যন্ত চলাচল করবে ট্রেন।
অন্যদিকে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের বাংলাদেশ অংশ ডুয়েলগেজ হলেও ভারতের অংশ এখন মিটারগেজ। ভারতের অংশটুকুও ব্রডগেজে রূপান্তর করার কাজ চলছে, তার আগ পর্যন্ত এ অংশে মিটারগেজ ট্রেনই চলবে বলে জানিয়েছেন আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (বাংলাদেশ অংশ) মো. আবু জাফর মিয়া।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দেড়বছর মেয়াদের এ রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রায় ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার।
এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশ পড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার, বাকিটা ভারতীয় অংশে পড়েছে।