দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার (০৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত ‘জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ২০১৯’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি।
বিচারকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আশা করি দেশ, দেশ ও জনগণ এবং সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বিচারকরা আপনারা আপনাদের মেধা-মনন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।’
‘আমি চাই না যে আমার মতো স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বছরের পর বছর কেউ অপেক্ষা করুক। সবাই যেন ন্যায়বিচার পায়, আইনের আশ্রয় পায়। যেটা আমাদের পবিত্র সংবিধানে আছে।’
দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব নাগরিক যাতে আইনের আশ্রয় লাভের সুবিধা পায়-সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবং সেটা আমরা করবো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় একটা জিনিস বিশ্বাস করেছি যেহেতু আমাদের সংবিধানে বলা আছে আইনের আশ্রয় লাভে সবার সমান অধিকার। আমরা তাতে বিশ্বাস করি। সবারই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকগুলো রায় খুব দ্রুত দেওয়ার ফলে আমি বলবো বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অনেক অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
বিচার বিভাগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ, যেমন জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় দেওয়া। অনেক বাধা ছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে এই রায় দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং এরকম বহু ঘটনা। সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদ, তারপর কিছুদিন আগে আপনারা দেখেছেন যে একটা ছাত্রীকে কীভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সেই বিচারের রায়, নুসরাত হত্যার কথা আমি বলছি। একেকটা দৃষ্টান্ত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি সম্পত্তি রক্ষা, ইভটিজিং প্রতিরোধ, পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় বন্ধ, যানবাহন সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত মোবাইল কোর্ট অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিক বিচার পাওয়ার ফলে বিচারিক কার্যক্রমের প্রতি তাদের আস্থা বেড়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০০৯-২০১৮ পর্যন্ত সময়ে ১০ বছরে ৪ লাখ ১১ হাজার ৭৭৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ১০ লাখ ১০ হাজার ৩৩৪টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং ২৯২ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৩২ হাজার ৮৮০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মূলত লঘু প্রকৃতির অপরাধ প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ফলে বিচার বিভাগের উপর চাপ হ্রাস পায় এবং মানুষ স্বস্তিবোধ করে। মোবাইল কোর্টকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা সম্ভব হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ এবং জনস্বার্থ বিশেষভাবে রক্ষিত হবে।
বাংলায় রায় লেখার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মামলার রায় লেখা হয় শুধু ইংরেজি ভাষায়, তাতে অনেক সময় আমাদের সাধারণ মানুষ যারা হয়তো ইংরেজি ভালো বোঝেও না, তারা কিন্তু ধোকায় পড়ে যায়। তারা সঠিক জানতে পারে না যে রায়টা কী হলো। সেজন্য ইংরেজিতে লেখা হোক কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় লেখা থাকা উচিত।’
বিচারকদের বেতন বৃদ্ধি, আলাদা বেতন কাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং অবকাঠামোগত সঙ্কট নিরসনে আমরা ৬৪টি জেলায় আধুনিক বহুতল চিফ জুডিশিয়াল আদালত ভবন নির্মাণের উদ্যোগ; ২৮টি জেলায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ জেলা জজ আদালত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ; সম্প্রতি সরকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের জন্য ১২৮টি গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন; বিচারকদের আবাসন ও গাড়ি সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বিচারকদের জন্য গাড়ি ঋণ নগদায়নের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
মামলা ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে ই-জুডিশিয়ারি কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের সব আদালতকে আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ই-জুডিশিয়ারি চালু করা গেলে মামলা জট কমবে।
জনসাধারণকে জাতীয় হেল্প লাইন ১৬৪৩০ নম্বরে টোল ফ্রি কলের মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রমুখ।