পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি দুর্বিষহ করে তুলেছে ক্রেতাদের। সরকারের নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও কমছে না পণ্যটির দাম। জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি দেশ থেকে প্লেনে করে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে, তবুও ক্রেতা নাগালের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি।
দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। সাধারণত স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পেঁয়াজের এই চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু এবার বিপত্তি বাঁধে যখন গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে প্রতি মেট্রিক টনে নূন্যতম ৮৫০ মার্কিন ডলার মূল্য নির্ধারণ করে। এরপর আবার ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
চলতি বছরে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। তবে দাম যাতে আর না বাড়ে, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাজারে খোঁজখবর নেওয়ার কাজ চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের কাছে দেশের পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি ও প্রতিযোগিতার অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের অনুরোধে করা ওই গবেষণা প্রতিবেদনের প্রাথমিক ফলাফল সম্প্রতি চূড়ান্ত করে জমা দেওয়া হয়েছে। এই গবেষণায় পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন, দাম বৃদ্ধি, কোন অঞ্চলের মানুষ বেশি পেঁয়াজ খায়, কোন অঞ্চলের মানুষ কম খায়, বাংলাদেশে কোথায় বেশি উৎপাদন হয়, কোথায় কম হয়- এসব বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বে পেঁয়াজের উৎপাদন কোথায় হয়, কোথায় কম হয় এসব তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়, সিলেট অঞ্চলের মানুষ বেশি পেঁয়াজ খায়। অন্যদিকে কম খায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। দেশে একেকটি পরিবারে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন এক কেজি ৫৬ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ চার কেজি ৯১ গ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পরিবারগুলো সেপ্টেম্বরে বেশি পেঁয়াজ ব্যবহার করে। এ মাসে সিলেট অঞ্চলের পরিবারগুলো গড়ে চার কেজি ৯১ গ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করে। অন্যদিকে, ঢাকায় তিন কেজি ৫৬ গ্রাম, রাজশাহীতে তিন কেজি ৭৪ গ্রাম চট্টগ্রামে তিন কেজি ১৯ গ্রাম, খুলনায় দুই কেজি ৬২ ও রংপুরে আড়াই কেজি পেঁয়াজ ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে দেশের পরিবারগুলোতে পেঁয়াজ কম ব্যবহার হয়ে থাকে। অফ সিজনের কারণে এ সময়ে পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকে বলে।
বিভাগ ভিত্তিক পেঁয়াজ খাওয়া নিয়ে গবেষণা করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন গবেষকেরা। বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদের নেতৃত্বে মূল গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণা বলছে, সিলেটে শহর ও গ্রাম অঞ্চলে সমানভাবে বেশি পেঁয়াজ ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে সারাদেশের হিসেবে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের পেঁয়াজ খাওয়ার প্রবণতা বেশি।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১০টি জেলায় বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষে ছিল পাবনা। জেলাটিতে চার লাখ ১৫ হাজার ৩৭২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল। এ বছর ফরিদপুরে দুই লাখ ৯০ হাজার ৪১৭, রাজবাড়ীতে দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮, রাজশাহীতে এক লাখ ৪২ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে কুষ্টিয়া। এই জেলায় এক লাখ নয় হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। মেহেরপুরে ৬৮ হাজার ৭২০, মাগুরায় ৫৪ হাজার ৩২৭, ঝিনাইদহে ৫৩ হাজার ৭০১, মানিকগঞ্জে ৪৮ হাজার ১৪৬ ও মাদারীপুরে ৪২ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে।
পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে চায়না। বিশ্বের ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ পেঁয়াজ চীনে উৎপাদিত হয়। এর পরিমাণ ২৩৯ লাখ আট হাজার মেট্রিক টন। এরপরেই ভারতের অবস্থান। ১৯৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় দেশটিতে। যা বিশ্বে মোট উৎপাদনের ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র এক দশমিক ৮৬ শতাংশ। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মূলত বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে প্রতিবছরই। দেশের অধিকাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
বিশ্বে পেঁয়াজ রফতানিতে শীর্ষে ভারত। এরপরে রয়েছে মিয়ানমার, আফগানিস্তান, মিশর, তুরস্ক, চীন, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশে ১৩ লাখ পরিবার পেঁয়াজ চাষের কাজে জড়িত। দেশের প্রায় সব জেলাতেই পেঁয়াজ হয়। প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ হয়।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বিআইডিএসকে দিয়ে পেঁয়াজের গবেষণা করিয়েছি। পেঁয়াজ নিয়ে স্থায়ী সমাধান খুঁজতেই এমন উদ্যোগ। পেঁয়াজের আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত নীতিমালা পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ, পেঁয়াজের বাজারজাতকরণ ও সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা চিহ্নিত করতে গবেষণাটি সহায়তা করবে।