‘চলন্তিকা বস্তি থেকে আমগো উচ্ছেদে লাইগ্যা বারবার আগুন দেওয়া হইতাছে। এগুলো সবই ষড়যন্ত্র। এর আগেরবারের আগুনে বস্তির বেশিরভাগ ঘরই পুইড়া গেলো। আমগো কাউরে ঘর তুলতে দেয় নাই। নেতারা আইছে, মেয়র আইছে, সবাই কইছে বস্তিবাসীর পুনর্বাসন করবো, কিছুই অয় নাই। এখন আবারও বস্তিতে আগুন লাগলো। এই আগুন লাগে নাই, লাগাইয়া দিছে।’
আগুনে পুরে যাওয়া ঘরের টিন সরাতে সরাতে এভাবেই অভিযোগ করছিলেন মো. আব্দুল মান্নান শেখ। ৪০ বছর ধরে মিরপুরের রূপনগরের সেকশন-৬ এর চলন্তিকা বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। মান্নান পেশায় একজন ভ্যানগাড়ি চালক। গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) ভোরে হঠাৎ আগুনে তার ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।। ঘরের কিছুই বের করতে পারেননি তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত মান্নান শেখ আরও বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। এরপরও টাকা জমাইয়া কিছু সম্পদ করছিলাম। তবে হঠাৎ আগুনে ঘরের সব পুড়ে শেষ। ঘরে আমার নগদ ২৩ হাজার টাকা ছিল, স্ত্রীর আধা ভরি সোনার গয়না, সবই পুইড়া গেছে। ঘরের যত আসবাবপত্র ছিল, সেগুলোও গেছে। আমার ৪০ বছরের সব কামাই শেষ।’
শুক্রবার ভোর ৪টা ৯ মিনিটে চলন্তিকা বস্তির সবাই যখন গভীর ঘুমে, ঠিক তখনই আগুনের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে বস্তির ঘরগুলোতে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুনে ছাই হয়ে গেছে বস্তির অন্তত তিনশ’র বেশি ঘর। আগুনে শফিক (২৩) ও পারভিন (৩৫) নামে দুইজন দগ্ধ হন। শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দগ্ধ পারভিনের মৃত্যু হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের অভিযোগ, আগুন এমনি এমনি লাগেনি, চলন্তিকা বস্তির বাসিন্দাদের উচ্ছেদের জন্য ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগানো হয়েছে।
বস্তিবাসীরা জানান, পাঁচ মাস আগে চলন্তিকা বস্তিতে একবার আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। তখন হাজারও ঘর পুরে ছাই হয়েছে। বস্তির হাজারও মানুষ আগুনে নিঃস্ব হয়েছে। এরপর বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আগুনের সূত্রপাত ও কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে তাদের। তদন্ত কমিটিতে থাকা অন্যরা হলেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. সালেহ উদ্দিন, সহকারী পরিচালক (অপারেশন) মো. আব্দুল হালিক, উপ সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন এবং মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আনোয়ার হোসেন।
শনিবার চলন্তিকা বস্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলোর আগুনে পোড়া টিন ও আসবাবপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো পিকআপে তোলা হচ্ছে। বেশিরভাগ বাসিন্দাই নিজেদের ঘরের জায়গাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, কিছু অবশিষ্ট রয়েছে কিনা। এদিকে, বস্তির বাসিন্দাদের বেশিরভাগকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও বসে অসহায়ভাবে সময় কাটাতে দেখা গেছে। পুড়ে যাওয়া বস্তিতে ঘর না থাকলেও অনেককেই টিউবয়েল কল চেপে গোসল করতে দেখা দেছে। আবার কেউ দুপুরের খাবারের জন্য ছোোছুটি করছেন।
২০ বছর ধরে চলন্তিকা বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মো. জুলহাস মিয়া। রাজধানীতে বিভিন্ন বাসের কন্ডাক্টার হিসেবে কাজ করে নিজের সংসার চালান তিনি। আগুনের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আামি এখন রাস্তার ফকির। যা কামাইছি সব পুড়ে গেছে।’
আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী পারভিনের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই নারী মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করতো। এখানে সে একাই থাততো। তার আর কেউ নাই। তাই তার লাশ এখনও মেডিক্যালেই পড়ে আছে। আগুনের সময় সে ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিল, বের হতে পারে নাই। বস্তিতে তার ৫টা ঘর ছিল।’
বস্তির বাসিন্দা হাসিনা বেগম বলেন, ‘যখন আগুন লাগে তখন সবাই ঘুমে ছিলে। মানুষের চিৎকারে আমরা ঘর থেকে বের হয়ে আসছি। তখনও আগুন জ্বলছে। এর কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দ হয়। মনে হলো কোনও গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ। এর পরপরই আগুন বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।’
তদন্ত কমিটির প্রধান ও ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘আগুনের ঘটনায় ওই বস্তির শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। এই ঘটনায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় বস্তির বাসিন্দাদের অনেকেই বলছে বস্তিতে ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবার কেউ কেউ বলছে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে। তবে আমরা সবদিক বিবেচনায় রেখেই আগুনের ঘটনার তদন্ত করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগুনের প্রকৃত সূত্রপাত জানতে ওই বস্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আমরা কথা বলবো। তদন্তের স্বার্থে তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হবে।’ তদন্ত শেষে আগুনের সূত্রপাত বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে বলে জানান তিনি।