ভয়াবহ ঝুঁকিতে খুলনা, এক বছরে এইডস শনাক্ত ৭১ মৃত্যু ২৫

খুলনা: খুলনায় এইডসের সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ বিভাগের মধ্যে এইডস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে খুলনা জেলায়।

যদিও এইডস প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নানা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি (এরআরটি) সেন্টারে শিশুসহ ৭১ জনের নমুনায় এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস শনাক্ত হয়েছে।

একই সময়ে এই জীবাণু বহনকারী শিশুসহ ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিভাগের মধ্যে শনাক্ত ও মৃত্যুতে শীর্ষ রয়েছে খুলনা জেলা।
আগের বছর খুলনা বিভাগে এইডস শনাক্ত হয়েছিল শিশুসহ ৬৫ জনের। মৃত্যু হয়েছিল শিশুসহ ১৮ জনের।

ওই সময়ে খুলনা জেলায় দুই শিশুসহ শনাক্ত হয় ২৮ জন এবং মৃত্যু হয় শিশুসহ ৮ জনের।
এই পরিসংখ্যানই বলছে, খুলনাঞ্চলে দিনে দিন বাড়ছে এইডসের শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বাদ পড়ছে না শিশুরাও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এইচআইভি সংক্রমণের এখনো কোনো প্রতিকার নেই। তবে কার্যকর এইচআইভি প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে রোগাক্রান্তদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

খুমেকের এআরটি সেন্টার থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সেন্টারে শিশুসহ এক হাজার ২০২ জনের রক্ত পরীক্ষা হয়, যার মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে শিশুসহ ৭১ জনের। এদের মধ্যে পুরুষ ৪৬ জন এবং নারী ২৩ জন। এর মধ্যে শিশু (পুরুষ) দুজন এবং শিশু (নারী) আছে ৩ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের আছেন দুজন।

এই সেন্টারে ভাইরাসটি যাদের শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে খুলনার বাসিন্দা ৩৫ জন, বাগেরহাটের ১১ জন, নড়াইলের ৭ জন, যশোরের ৯ জন, সাতক্ষীরার ৩, গোপালগঞ্জের ২ এবং বরগুনা, বরিশাল, ঝিনাইদহ ও নারায়ণগঞ্জের একজন করে রয়েছেন।

এ সময়ের মধ্যে মোট ২৫ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে খুলনার বাসিন্দা ৮ জন, সাতক্ষীরার ২ জন, যশোরের ৭ জন, নড়াইলের ৩ জন, বাগেরহাটের ৩ জন, মেহেরপুরের ১ জন এবং রাজশাহীর ১ জন রয়েছেন। মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে পুরুষ ১৬ জন এবং নারী আছে ৯ জন। এর মধ্যে ১০ বছরের শিশুও (পুরুষ) রয়েছে। সে ছিল যশোরের বাসিন্দা।

খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টারে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯২৩ জনের এইডস পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে তিন শিশুসহ ৬৫ জনের এইডস শনাক্ত করা হয়। শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৩৩ জন এবং নারী ৩২ জন ছিলেন। এই সময়ে মৃত্যু হয় ১৮ জনের।

জানা যায়, গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টারে নতুন করে ১১৬ জনকে এইচআইভি/এইডস চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। যার মধ্যে খুমেকের এআরটি থেকে শনাক্ত হয় ৭১ জন। বাকি ৪৫ জনকে বিভিন্ন জেলার এনজিও ও সরকারি হাসপাতাল থেকে রেফার্ড করা হয়। এর মধ্যে বিএসএমএমইউ এআরটি সেন্টার থেকে তিনজন, ঢাকার সংক্রামকব্যাধি হাসপাতাল থেকে ২ জন, সিরাজগঞ্জ এআরটি থেকে ১ জন, যশোর এরআরটি থেকে ১৫ জন, সিলেট এআরটি থেকে ১ জন, ডিএএম (এমএসএম) এনজিও অফিস থেকে ১০ জন এবং আশার আলো সোসাইটি (এএএস) এনজিও অফিস থেকে ১৩ জন এসেছেন।

নতুন সেবাপ্রাপ্ত রোগীদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ৪০ জন, সমকামী ৪৪ জন, যৌনকর্মী ৫ জন, যক্ষা রোগী ১০ জন, যৌনকর্মী (পার্টনার) তিনজন, হিজড়া ৩ জন, বিদেশে অবস্থান (আসা যাওয়া) ৫ জন, এইডস পার্টনার ২ জন ও সমকামী পার্টনার ১০ জন রয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (মেডিসিন) ও এআরটি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. দীপ কুমার দাশ বলেন, এই হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য ‘প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন’ (পিএমসিটি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু আছে। এই প্রোগ্রামে এইচআইভি/এইডস পজিটিভ নারীর গর্ভের সন্তনটি যেন এইচআইভি নেগেটিভ হয়, সে সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ সেন্টার থেকে সব পর্যায়ে মানুষের জন্য বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। একইসঙ্গে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের সব ধরনের পরীক্ষা এবং ১৫-১৬ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও একাধিক কারণে এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে। এইডসের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ (এইচআইভি) নামের রেট্রোভাইরাসটি। মানুষের রক্ত ও অন্যান্য দেহ রসেই একমাত্র বেঁচে থাকে এই ভাইরাস। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি সর্দি-কাশিকেও আটকাতে পারে না শরীর।

খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (সিএস) ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা বলেন, এইডস থেকে বাঁচতে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে। যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে। অনিরাপদ যৌনতায় কনডম ব্যবহার খুবই জরুরি। একবার ব্যবহৃত সিরিঞ্জ বা নিডল পুনরায় ব্যবহার না করা, শরীরে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের প্রয়োজন হলে, কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করার পূর্বে রুটিনলি এইচআইভি টেস্ট করা, এইচআইভি আক্রান্ত মাকে থেরাপির আওতায় আনতে হবে। বিপুল জনসচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে, বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে খুলনা সিভিল সার্জন দপ্তরের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা সিভিল সার্জন অফিস চত্বর থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি শুরু হবে এবং পরে সিভিল সার্জনের সম্মেলনকক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘কমিউনিটির আমন্ত্রণ, এইডস হবে নিয়ন্ত্রণ’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *