কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গত কিছুদিন সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই অভিযানে মারা যায় অনেক ‘রোহিঙ্গা ডাকাত’। ফলে নতুন করে দল গোছাতে সম্প্রতি ফের সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে তারা। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও বেড়ে গেছে তাদের আনাগোনা। জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায়ই অস্ত্র নিয়ে হানা দেয় ডাকাত জকির ও ডাকাত আবদুল হাকিমের বাহিনী। এছাড়াও এই এলাকার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পাহাড়ি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আরও বিশ জন শীর্ষ ডাকাত। তারা ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাই, খুন, মানবপাচার ও মাদক কারবারে জড়িত।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ‘টপ মোস্ট ক্রিমিনাল’ (ডাকাতদের)-দের দ্রুত ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা আছে: জকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত, হাসান প্রকাশ কামাল, খলিফা সেলিম, খায়রুল নবী, মোহাম্মদ রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক, দোস মোহাম্মদ, নুরু মিয়া প্রকাশ ভুইল্ল্যা, মোহাম্মদ নুর, বনি আমিন, সালমান শাহ, রশিদ উল্লাহ, খায়রুল আমিন, মহি উদ্দিন ওরফে মাহিন, সাদ্দাম হোসেনসহ ২২ ডাকাতকে যত দ্রুত সম্ভব ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
এ বিষয়টি স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ডাকাতদের একটি তালিকা হাতে পেয়েছি। তাদের ধরতে বিশেষ অভিযান চলছে। কোনও অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেকের সঙ্গে কথা হয় এসব ব্যাপারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গারা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় ২০ জনের বেশি শীর্ষ ডাকাত সক্রিয়া রয়েছে। তারা নিয়ন্ত্রণ করছে ৩০টিরও বেশির রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তাদের চার-পাচঁটি গ্রুপ রয়েছে। এই ডাকাত গ্রুপের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছে জকির আহমদ ওরফে ডাকাত জকির। অপর একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে ডাকাত আবদুল হাকিম। বিভিন্ন ডাকাত দলে শতাধিক সদস্য রয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওপর নজর রাখেন এমন একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ডাকাত দলের আরও যারা সক্রিয় রয়েছে তারা হলো- আনোয়ার সাদেক, দিল মোহাম্মদ, হামিদ মাঝি, নুর মিয়া, নুর কালাম, করিম, আলী হোসেন, হাসিম উল্লাহ, মুক্তার হাসান, সোনা মিয়া, ফরিদ আলম ওরফে ফয়েজু, কালা আমান উল্লাহ, পুতিয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করা ডাকাতের তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রে আরও জানা গেছে, এদিকে এই বছরের ১২ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোট ২৪ জন নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ১৭ জন ছিল সক্রিয় ডাকাত। এর মধ্যে গত ২ মার্চ র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ ৭ জন রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হয়। সর্বশেষ (১২ মার্চ) বৃহস্পতিবারও ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হয় ২ ডাকাত। তারা সবাই জকির বাহিনীর সদস্য ছিল। সদস্য কমে যাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে ডাকাত বাহিনী।
রোহিঙ্গাদের অপরাধের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়: ২০১৭ সালে অস্ত্র মামলা হয় ১২টি, ২০১৮ সালে ১৩টি ও ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ২৫টি। ২০১৭ সালে মাদক মামলার সংখ্যা ছিল ২২টি, ২০১৮ সালে ৯৫ ও ২০১৯ সালে ৯১টি। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মামলা ২০১৭ সালে ২টি, ২০১৮ সালে ১৬টি ও ২০১৯ সালে ১৩টি। অপহরণ মামলা ২০১৭ সালে একটিও ছিল না। ২০১৮ সালে ৯টি ও ২০১৯ সালে ১০টি। ডাকাতি ও ডাকাতি প্রস্তুতির মামলা ২০১৭ সালে ২টি, ২০১৮ সালে ৭টি। হত্যা মামলা ২০১৭ সালে ৮টি, ২০১৮ সালে ১৫টি ও ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪০টি। মানব পাচার মামলা ২০১৭ সালে একটিও ছিল না। ২০১৮ সালে ২টি ও ২০১৯ সালে ২৫টি।
টেকনাফ শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন নেতা বলেন, ‘ঘনবসতি হওয়ায় ডাকাত বাহিনীরা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের গোপন আস্তনা তৈরি করছে। শুধু ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নয়, কক্সবাজারে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছেও এসব ডাকাত বাহিনী আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ডাকাত বাহিনী নতুন করে সদস্য সংগ্রহে নেমেছে।’
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনায় লোক মারাও গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্প ও আশপাশে চার-পাঁচটি ডাকাত বাহিনী আছে। এর মধ্যে টেকনাফের আবদুল হাকিম ও জকির বাহিনী বেশি তৎপর। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন-তখন লোকজনকে অপহরণ করে, মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে। ইয়াবা ও মানবপাচারে যুক্ত থাকার পাশাপাশি এই বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায়।’
জানতে চাইলে র্যাব-১৫ এর টেকনাফ সিপিসি-১ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট (বিএন) মির্জা শাহেদ মাহাতাব বলেন, ‘ডাকাতদের ধরতে র্যাবের বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি সময়ে র্যাবের সঙ্গে ডাকাত বাহিনীর গোলাগুলিতে ১০ জনের বেশি ডাকাত নিহত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা র্যাবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে অপরাধের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে ডাকাত বাহিনীরা নতুন করে সদস্য সংগ্রহে নেমেছে। তবে ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় কাউকে কোনও ধরনের অপরাধে জড়াতে দেওয়া হবে না। জকির ও হাকিমসহ কয়েকজন ডাকাতকে খোঁজা হচ্ছে।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পের পাশে পাহাড়ি ডাকাতদের অপরাধ প্রবণতা বাড়লেও পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। তাছাড়া আমাদের অভিযান ও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও নজরদারি রয়েছে।