শাহ আমানত বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি, নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সিন্ডিকেট

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বেড়েছে। বকশিশের নামে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্য, গাড়িচালক এবং বহিরাগতদের সিন্ডিকেট এ হয়রানি করছে।

সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর সৌদি আরবগামী এক যাত্রীকে এপিবিএনের এএসআই রাজীবের নেতৃত্বে মারধর করা হয়।
প্রবাসীদের অভিযোগ, বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মচারী বৈধ ভিজিট ভিসাসহ যাবতীয় ট্রাভেল ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও ভিজিট ভিসাধারীদের আসতে হয়রানি করছে।

এছাড়া ট্যুরিস্ট ভিসার যাত্রীরা বিদেশে যেতে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগে কন্ট্রাক্ট করতে হয়। অন্যথায় তারা হয়রানি করে।
আবার বিমান থেকে নামতেই শুরু হয় হয়রানি। কাস্টমস কর্মকর্তারা অবৈধ মালামাল খোঁজার অজুহাতে লাগেজ খুলে তন্নতন্ন করে।
অবৈধ মালামাল না পেলেও তারা লাগেজ বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা করে না। এ কারণে বিমানবন্দরেই প্রবাসীদের অনেক মালামাল হারিয়ে যায়। বিমানবন্দরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্য, গাড়িচালকদের সিন্ডিকেট বকশিশের জন্য যাত্রীদের হয়রানি করছে।
সম্প্রতি অটোরিকশা পার্কিং করাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জেরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এএসআই রাজীবের নেতৃত্বে নুরুল আমিন নামের এক সৌদি আরবগামী যাত্রীকে মারধর করা হয়। লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরুল আমিনের অভিযোগ, বিকেলে ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরে গিয়ে গাড়ি পার্কিং নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। এপিবিএনের ওই এএসআইয়ের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাকে একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করে এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা অন্য কক্ষে নিয়ে যান এবং সমঝোতার চেষ্টা করেন।

আরব আমিরাত প্রবাসী সাইফুল আলম বলেন, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রেখেছেন প্রবাসীরা। অথচ বিমানবন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি প্রবাসীর ব্যাগ গায়েব, ব্যাগ থেকে মালামাল চুরির ঘটনাও ঘটছে। বিমানবন্দর থেকে বের হলেই ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করেন আনসার-সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্মীরা। মালামাল ট্রলিতে নিয়ে বের করে দেওয়ার কথা বলে বিদেশি মুদ্রা দাবি করেন।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কমপক্ষে ৯ খাতে যাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় এবং নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়। বিমানবন্দরে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে- সিভিল অ্যাভিয়েশন, ইমিগ্রেশন, আনসার-এপিবিএন ও বিভিন্ন এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমস। এদের মধ্যে সিভিল অ্যাভিয়েশন এবং কাস্টমস সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে। নিরাপত্তা প্রহরীরা নানাভাবে যাত্রীদের টাকার জন্য হয়রানি করেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় আনসার সদস্যদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রায়ই মালামাল লুকিয়ে রেখে আনসার সদস্যরা ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ আদায় করেন। একইভাবে যাত্রী বিমানবন্দর ত্যাগের সময়ও আনসার সদস্যরা বকশিশ আদায় করেন। যাত্রীরা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীরা লাগেজ নিয়ে টানাটানি করে। অটোরিকশা ঠিক করে দেওয়া কিংবা মালামাল একটু এগিয়ে দেওয়ার নামে ১০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ আদায় করে।

কাঁচি ও আয়রন জাতীয় ধাতব বস্তু এবং শুঁটকি, ফলমূল, রান্না করা খাবার, কাঁঠালের মতো পচনশীল বস্তু পরিবহনের উপযুক্ত না হলেও ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে সেগুলো পরিবহনের সুযোগ দেন সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মীরা। বহির্গমন কার্ড পূরণের জন্য যাত্রী বিশেষত প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নেন সিভিল অ্যাভিয়েশন, ইমিগ্রেশন বিভাগ ও এয়ারলাইনসে কর্মরতরা।

ভিজিট ভিসার মাধ্যমে যারা মধ্যপ্রাচ্যে যান তাদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ভিসার মেয়াদ কম, ছবি ঠিক নেই এমন সব অজুহাতে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। ১০০ টাকা কিংবা ২৫ মার্কিন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকের এখতিয়ার কাস্টমস কর্তৃপক্ষের থাকলেও চূড়ান্ত চেকের সময় নিরাপত্তা কর্মীরা সেগুলো জোরপূর্বক কেড়ে নেন। বোর্ডিং লাউঞ্জে খাবারের দাম বাইরের দোকানের চেয়ে বেশি।

শুল্ক বিভাগের কর্মীদের একাংশের সহায়তায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে মদ-তামাক জাতীয় আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য ছাড় করা হয়। আবার যাত্রীরা শর্ত সাপেক্ষে আমদানিযোগ্য টেলিভিশন, স্বর্ণের বার, মোবাইল, শাড়ি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। পার্কিং এলাকায় মধ্যস্বত্তভোগী চক্রের দৌরাত্ম্য আছে। তাদের জন্য বিমানবন্দরের যাত্রীদের বাড়তি টাকা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করতে হয়।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, দুবাই, ওমান, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরবে যাচ্ছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের হয়রানি না করার জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশের সমন্বয়ে সভাও হয়েছে। এরপরও মাঝে-মধ্যে হয়রানির অভিযোগ আসে।

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের হয়রানি বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি প্রবাসীদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করারও অনুরোধ জানান।

খোরশেদ আলম সুজন বলেন, হযরত শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অবহিত করেছেন। প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের স্বার্থে এবং মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের যাতায়াত সহজীকরণে চট্টগ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান হয়রানি বন্ধ করা জরুরি। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের প্রবাসীরা যেন খুব সহজে ও নির্বিঘ্নে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গমন করতে পারেন সেজন্য ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় হয়রানি দূরীকরণে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ করেছি।

বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক আবদুল কুদ্দুস বলেন, একজন প্রবাসী যাত্রীকে মারধরের অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যিনি দোষী হবেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। রোববার ওই কমিটিকে দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসনিম আহমেদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *