চার ভাইয়ের মধ্যে একজন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তা। আরেক ভাই ঢাকায় ব্রিটিশ ল’ শেষ করে ব্যারিস্টারি পড়তে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্যে। সবার ছোট ভাই সম্প্রতি বুয়েট থেকে পাস করেছেন। স্ত্রীও ব্যারিস্টারি পড়ছেন যুক্তরাজ্যে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি নিজেও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) পাস করেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছিল তার। চাকরিও করেছেন বড় কোম্পানিতে। কিন্তু, সব ছেড়ে এখন তিনি অপহরণ, ছিনতাই আর চাঁদাবাজি করে বেড়ান। দলে রয়েছে ১০-১২ জনের একটি ক্যাডার বাহিনী। তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সুচতুরভাবে অপরাধ করে বেড়ানো এই ব্যক্তির নাম মশিউর রহমান পাপ্পু (৩৪)। তবে শেষরক্ষা হয়নি তার। ইংলিশ মিডিয়ামের এক ছাত্রসহ দুই তরুণকে অপহরণের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পাপ্পু একটি ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করে আসছিল। এই বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্যকে সে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান ও চাঁদ হাউজিংয়ের তিনটি বাসায় রাখতো। তার নিজের একটি প্রাইভেটকার আর তিনটি মোটরসাইকেল রয়েছে। এগুলো তিনি ব্যবহার করতেন অপহরণ ও ছিনতাই কাজে। সর্বশেষ কুড়িগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলামের ছেলে তানজিম আল ইসলাম দিবস ও তার মামা খালিদ হাসান ধ্রুবকে অপহরণ করে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগ তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পাপ্পুর অপরাধ সাম্রাজ্যের সন্ধান পায়। পাপ্পুর সঙ্গে গ্রেফতার করে তার সাত সহযোগীকে।
গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলো মাহমুদুর রহমান রাসেল ওরফে রচি (৩০), রশিদুজ্জামান ওরফে তুষার (৩২), শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি (৩২), ইমতিয়াজ আহমেদ (২৮), আরিফুল ইসলাম ওরফে নিশান (৩২), ফকর উদ্দিন (২৪) ও আব্দুল্লাহ আল নোমান (৩০)। তাদের কাছ থেকে অপহরণ কাজে ব্যবহৃত ১টি প্রাইভেটকার, ৩টি মোটরসাইকেল, ম্যাগজিনসহ ১টি পিস্তল, ৫টি ডিএমপি’র ডিবি পুলিশের পোশাক (জ্যাকেট), ডিএমপি’র পুলিশ সার্জেন্টের র্যাঙ্কব্যাজসহ ১টি ইউনিফর্ম শার্ট এবং পুলিশ কনস্টেবল পদমর্যাদার ১টি শার্ট, ৭টি স্টিলের লাঠি, ৩টি কালো রঙের ছোট-বড় ওয়্যারলেস সেট, ৪টি পিস্তল-সদৃশ লাইটার, ৫টি সিরিঞ্জ, ২০টি ইনজেকশন, ১ সেট সেনাবাহিনীর পোশাক তৈরির থান কাপড়, ১৫টি বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সেট (সিম সংযুক্ত) এবং অ্যাপল কোম্পানির ১টি আইপ্যাড উদ্ধার করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘পাপ্পু খুবই চতুর ও তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ একজন অপরাধী। সে সংঘবদ্ধভাবে অপরাধ করে বেড়াতো। তার দলে ১০-১২ জন সদস্য রয়েছে। এদের সে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতো। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলার পাশাপাশি মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
যেভাবে দিবস ও ধ্রুবকে অপহরণ করেছিল তারা
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, একটি মামলার সূত্র ধরে কুড়িগ্রামের আইনজীবী নেতা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হয় পাপ্পুর। ফখরুল ইসলাম যেকোনও সময় ২০-৩০ লাখ টাকা ম্যানেজ করে দিতে পারবে মনে করে তার ছেলেকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এরপর ফখরুল ইসলামের ফেসবুক আইডি থেকে তার ছেলে দিবসের তথ্য সংগ্রহ করে পাপ্পু। এরপর তার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করে। দিবসকে তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহ আছে দেখে তাকে কম্পিউটার সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে। দিবস ঢাকাতেই থাকতো। ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার সঙ্গে যোগাযোগের পর দিবস তার মোবাইল নম্বর পাপ্পুকে দেয়। এই নম্বরে যোগাযোগ করলে ২১ জানুয়ারি দুপুরে তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয় দিবস। সে অনুযায়ী পাপ্পু আগে থেকেই তার সন্ত্রাসী বাহিনীর চার সদস্যকে নিজ গাড়ি দিয়ে তাজমহল রোডের মিনার মসজিদের কাছে পাঠায়। সে নিজে একটি মোটরসাইকেলে একটু দূরে অবস্থান নেয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাপ্পু জানায়, দিবসকে তুলে আনার দায়িত্ব দিয়েছিল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড মাহমুদুর রহমান রাসেল ওরফে রচিকে। রচি খেলনা অস্ত্র কোমরে গুঁজে দিবসের একটি ছবি হাতে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে দিবসকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। দিবসের সঙ্গে থাকা ধ্রুবকেও তুলে নেয় গাড়িতে। কালো গ্লাসের প্রাইভেটকারে বসিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের ঢাকা উদ্যানে থাকা পাপ্পুর গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের হাত-পা ও চোখ স্কচটেপ দিয়ে বেঁধে রাখে। পাপ্পু জানায়, ওই গোডাউনে ঝুট কাপড় রাখার পাশাপাশি সে অপহৃতদের আটকে রাখতো।
অপহরণের কোড নাম ছিল ‘নৌকা’
গ্রেফতার হওয়া অপহরণকারী ও অপহৃতদের স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, অপহরণের পর দিবসের বাবার সঙ্গে মুক্তিপণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাপ্পুর সেকেন্ড ইন কমান্ড মাহমুদুর রহমান রাসেল ওরফে রচিকে। রচি রংপুরের পীরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ছিল। এ কারণে সে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের এই অপারেশনের কোড নাম দেয় ‘নৌকা’। পাপ্পুর হয়ে রচি কয়েক দফায় একেক নম্বর থেকে ফোন করে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। থানা পুলিশকে জানানোর কারণে গালাগালিও করে। দিবসের বাবাকে জানিয়ে দেয়, ‘নৌকা’ কোড নাম ব্যবহার করে আপনার সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করা হবে।
দিবসের বাবা ফখরুল ইসলাম জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা যতবার তাকে ফোন দিয়েছে ততবারই ‘নৌকা’ কোড নামের কথা বলেছে। তারপর মুক্তিপণের টাকা নিয়ে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাপ্পু ও রচি জানিয়েছে, তারা এমনিতেই টাঙ্গাইলের কথা বলেছিল। দূরে কোথাও থেকে যেন মুক্তিপণের টাকাটা নিতে পারে।
যেভাবে উদ্ধার করা হলো তাদের
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অপহরণের পরপরই তারা প্রথাগত ও প্রযুক্তির সহায়তায় অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু, অপহরণকারীরা তাদের অবস্থান বারবার পরিবর্তন করছিল। প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের অবস্থান কখনও সিলেট আবার কখনও চট্টগ্রামে দেখা যাচ্ছিল। পরবর্তীতে প্রথাগত একটি সোর্সের মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপহরণকারীদের ঢাকা উদ্যান ও চাঁদ হাউজিংয়ের তিনটি আস্তানার সন্ধান পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ওই তিন আস্তানা থেকে তারা কয়েকটি পুলিশের পোশাক, একাধিক খেলনা পিস্তল, ওয়াকিটকি ও অচেতন করে রাখার ইনজেকশন উদ্ধার করেন। সেখানে পাওয়া একটি ক্লু-এর সূত্র ধরে অপহৃত দুইজনকে উদ্ধারের অভিযান চলতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে পাপ্পু জানায়, পুলিশের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে তারা আগেই দুই ভিকটিমকে গাড়িতে তুলে চট্টগ্রামের দিকে চলে যায়। পাপ্পু নিজেও সহযোগী ইমতিয়াজকে নিয়ে ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেলে ওঠে। পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের কারণে সে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে পাসপোর্টও সঙ্গে নিয়ে যায়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে ডেমরা এলাকা থেকে গাড়িতে দুই ভিকটিমসহ চার জনকে আটক করে। ভিকটিমদের উদ্ধার করে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অপহরণকারীদের নিয়ে সহযোগী ও মাস্টারমাইন্ডদের ধরতে অভিযান শুরু করে। ফাঁদ পেতে ফকিরাপুল এলাকা থেকে তুষার ও শফিকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তদের দেওয়া তথ্যমতে ধরা হয় মাস্টারমাইন্ড পাপ্পু ও তার সহযোগী ইমতিয়াজকে।
তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষ এই পাপ্পু
জিজ্ঞাসাবাদে পাপ্পু জানিয়েছে, অপহরণ করার জন্য নিজের গাড়ির নম্বর বারবার পাল্টাতো সে। এজন্য একাধিক নম্বর প্লেট ব্যবহার করতো সে। তবে কোনও ঘটনাতেই সে সরাসরি নিজে উপস্থিত থাকতো না। দূরে থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতো। দিবস ও ধ্রুবকে অপহরণের আগে সে সাতটি নতুন মোবাইল কেনে। সংগ্রহ করে এক ডজন অনিবন্ধিত মোবাইল সিম। এছাড়া যে মোবাইল থেকে ভিকটিমের বাবাকে ফোন করেছিল সেই নম্বর পুলিশ ট্র্যাক করতে পারে এজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি রেখেছিল সে। এজন্য একটি পেইড সফটওয়্যার ব্যবহার করতো সে। ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ঢাকায় বসে কল করলেও যেকোনও জায়গার নাম সেট করে দেওয়া যায়।
পাপ্পু জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই সে এই পেইড সফটওয়্যারের নাম জানতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে ট্র্যাক করতে না পারে সেজন্য সে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিল। এছাড়া সে তার অপহরণকারী চক্রের সবাইকে মোবাইল ব্যবহারে সতর্ক থাকার নির্দেশনাও দেয়। এমনকি ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের সে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ ও শপথবাক্য পাঠ করিয়ে নেয়।
আগেও ছিনতাই-অপহরণ করেছে তারা
জিজ্ঞাসাবাদ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই অপহরণের আগেও তারা একাধিক ছিনতাই ও অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে আব্দুল্লাহ আল নোমান নামে এক ব্যক্তির গাড়ি ছিনতাই করেছিল পাপ্পু। কিন্তু গাড়ি নিয়ে পালিয়ে আসার সময় দুর্ঘটনার কারণে গাড়ি ছেড়ে আসতে হয় তাদের। ওই সময় শামীম নামে এক সহযোগী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের কারাগারে রয়েছে।
পাপ্পু জানিয়েছে, তার স্ত্রীর দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই নোমানের গাড়িটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে সে। গাড়িটি ছিনতাইয়ের আগে তার লোকজন নোমানকে বেশ কয়েকদিন অনুসরণ করে। এজন্য সে পাঁচটি জিপিআরএস কেনে। তার সহযোগীরা নোমানের গাড়িতে একাধিকবার জিপিআরএস লাগিয়েছিল। কিন্তু ব্যাটারির চার্জ শেষ হওয়ায় সেগুলো দিয়ে ট্র্যাক করতে পারেনি। পরে নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই অনুসরণ করে গাড়িটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করেন, এই গ্রুপটি রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত ছিনতাই করে বেড়াতো। তাদের রিমান্ডে নিয়ে এসব জানার চেষ্টা চলছে।