পাঁচদিন আগে রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসেন নরসিংদীর হাসান মজুমদার (ছদ্মনাম)। হাসান জানান, তিনি ১০ দিন আগে দুবাই থেকে এসেছেন। হাসপাতালে এসেছেন জ্বর আর কাশি নিয়ে। দেশে ফেরার পর হোম কোয়ারেন্টাইনে যাননি হাসান, উল্টো ঢাকায় এসে আত্মীয়ের বাড়িতেই ছিলেন। হঠাৎ জ্বর হওয়ায় ঢাকাতেই এই হাসপাতালে এসেছেন।
গত ৫ মার্চ ইতালি থেকে দেশে ফেরেন চট্টগ্রামের নিঝুম সরকার (ছদ্মনাম)। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাজেক যাওয়ার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসেন আরও কয়েকজনকে। বেশ কিছুদিন তারা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর রব হলের একটি কক্ষে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সোমবার (১৬ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রসহ ছয়জনকেই চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
খিলক্ষেতের লেকসিটি কনকর্ডের একটি ভবনের একজন গৃহবধূ অভিযোগ করেন, পাশের ভবনে তার সন্তানের এক সহপাঠী থাকে। স্কুলপড়ুয়া ওই শিশুর ইতালিফেরত মামা ৪/৫ দিন আগে তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে সবখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে প্রতিবেশীরা আতঙ্কে আছেন বলে জানান ওই গৃহবধূ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, তাদের কয়েকজন আত্মীয় রয়েছেন যারা অতি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকেননি, অথচ তাদের বারবার বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু তারা দিব্যি ঘরের বাইরে আড্ডা দিয়ে, শপিং করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
হোম কোয়ারেন্টাইন নিয়ে সরকারের অনুরোধ, গণবিজ্ঞপ্তি জারি, মানিকগঞ্জে জরিমানা—এসব কিছু এখনও বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে নিতে পারছে না। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দাবি, গত দুই মাসে বাংলাদেশ হোম কোয়ারেন্টাইনের যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা কোনও দেশই নেয়নি।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশ আড়াই মাসের মতো সময় পেয়েছে, এতদিনেও কেন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করার মতো ব্যবস্থা করতে পারলো না—এমনপ্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবস্থা তো হয়েছেই। হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা হয়েছে। গত দুই মাস ধরে আমরা হোম কোয়ারেন্টাইনের যে ব্যবস্থা নিয়েছি, সেটা কোনও দেশই নেয়নি। সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী উত্তর দেননি।
হোম কোয়ারেন্টাইন পুরোপুরি হচ্ছে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটা মোটেই সঠিকভাবে হচ্ছে না। যারাই বিদেশ থেকে আসছেন, তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া দরকার, এখানে ছাড় দেওয়া যাবে না। তাদের কোয়ারেন্টাইনে না নিলে এটা ছড়িয়ে যাবে। প্রয়োজনে কারাদণ্ড, জরিমানা যা যা দরকার সব করতে হবে, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োগ করতে হবে—বলেন অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইনের গুরুত্বই অনেকে বোঝেন না। যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারা বাড়ি চলে গিয়েছেন। তাদের বেলায় কেবল স্পর্শ না সংশ্রব-ই যথেষ্ট মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংস্পর্শে কেউ আসতে পারবে না, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র কেউ ব্যবহার করতে পারবে না, সেগুলো বাইরেও যাবে না, কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব।
তিনি বলেন, আমার কাছেই অনেক খবর রয়েছে যারা বিদেশ থেকে এসেছেন তারা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, তাদের লক্ষণ-উপসর্গ না থাকলেও তার ক্যারিয়ার হতে পারেন, তারা ক্রমাগতই ছড়িয়ে পড়ছেন, সুতরাং হোম কোয়ারেন্টাইন কতটুকু হচ্ছে, সেটা ফিল্ডে যারা আছেন তারাই বলতে পারবেন। কিন্তু এটা সাংঘাতিক রকমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোয়ারেন্টাইন ঠিকমতো না হলে পুরো দেশ ঝুঁকিতে পড়বে।
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান বলেন, গত দুই মাসে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশ থেকে ফিরেছে বলে গণমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছি, এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে ঢুকে পড়ার ঝুঁকি আছে। ইতোমধ্যে দেখেছি, যেসব দেশের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়া শুরু করেছিল, সেসব দেশ থেকেই বাংলাদেশিরা এসেছেন বেশি।
কমিউনিটি লেভেলে হয়তো এটা ভালোভাবেই ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছি জানিয়ে আতিক আহসান বলেন, যদিও সরকার এখন অনেক কিছুই করছে, কিন্তু তার আগেই ছড়িয়ে পড়েছে বলে আমার আশঙ্কা। তাই এখন অন্যদের চেয়ে যারা বৃদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদি অসুখে আক্রান্ত, তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত সরকারের, বলেন আতিক আহসান।
বাংলাদেশের কালচারে হোম কোয়ারেন্টাইন আসলেই কাজ করবে বলে মনে হয় কিনা প্রশ্ন করে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক জোয়ার্দার বলেন, কৌশল হিসেবে এটা ঠিক কৌশল ছিল কিনা সে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তারও আগে ভাবতে হবে, এই হোম কোয়ারেন্টাইনের কথা কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা রিকমেন্ড করেছে কিনা? আমার জানা মতে করেনি।
কোয়ারেন্টাইন সবসময় ‘ইনফোর্সড’ হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইন বাংলাদেশে কখনও কাজ করবে না। কাজ যে করছে না সেটা আজকেই প্রমাণ হয়ে গেছে। বাসায় থেকে কোনোদিন কোয়ারেন্টাইন হবে না বাংলাদেশে।
এ বিষয়ে সোমবার সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা আবারও অনুরোধ করছি, যারা বাইরে থেকে আসছি, তারা যেন পরিবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। আমরা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছি তাতে সমাজ থেকে তাদের দূরে রাখতে পারবো। যদি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে রাখা না যায়, তাহলে এ রোগের সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে।
লোকাল ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে এবং হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টি দেশে ঠিকভাবে মানা হয়েছে কিনা প্রশ্নে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের দেশে যখন কেস পাওয়া যায়নি, তখন সে বিষয়ে এতো কড়াকড়ি করা বিধিসম্মত না। এখন যখন রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তখনই কিন্তু আমরা কঠোর হচ্ছি।
ইতালি ফেরত ১৪২ জনকে ছেড়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের প্রত্যেককে ট্র্যাক করা হচ্ছে, সবার মোবাইল নম্বর, ঠিকানাসহ সবকিছু জেলা প্রাশসক-পুলিশ সুপারদের দেওয়া হয়েছে, তাদের পুলিশ পাহারায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ভালো আছে।