সাইনবোর্ড লাগানোর আগে রূপনগর বস্তির ঘরগুলো ভেঙেছিল কারা?

রাজধানীর রূপনগরে পুড়ে যাওয়া বস্তির চারপাশে লাগানো রয়েছে ৪/৫টি বড় সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে—‘ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্ধারিত স্থান, বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।’ এই সাইনবোর্ডগুলো লাগানোর আগে রূপনগর বস্তির অন্তত ২০টিরও বেশি ঘর ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙতে আসা লোকজন বলেছিল—‘এটা সরকারি জায়গা। এখানে ঘরগুলো বানিয়েছে কারা? এখানে কেউ ঢুকতে পারবে না।’

পাঁচ মাস আগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এই সাইনবোর্ডগুলো স্থাপন করেছে বলে জানিয়েছেন বস্তির বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ—সাইনবোর্ড লাগানোর কয়েকদিন আগে লোকজন এসে বস্তির ঘর ভেঙে দেয়। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ না করলেও তাদের ধারণা—যারা সাইনবোর্ড লাগিয়েছে, তারাই লোকজন দিয়ে ঘর ভেঙে বস্তি উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল। ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলার মাসখানেক পর স্থানীয় সংসদ সদস্যের আশ্বাসে আবারও নতুন করে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন বস্তির বাসিন্দারা।

রূপনগর থানার কাছেই বস্তির উত্তর দিকের অংশে ২০১৯ সালের আগস্টে আরও একবার আগুন লেগেছিল। ওই আগুনে বস্তির প্রায় সব ঘর পুড়ে যায়। জানা যায়, সেই আগুনে পুড়ে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যে আবারও নতুন করে গড়ে ওঠা ঘরগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। ঘর ভাঙার পর এসব সাইনবোর্ড লাগিয়ে যায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

সাইনবোর্ড লাগানোর পর ২০১৯ সালের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের নাম-ঠিকানাসহ ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সংগ্রহ করে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। এরপর আর কোনও খবর নেই বলে জানান স্থানীয়রা।

বস্তির বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন অন্যপাশে আগুন লাগছে। আগেরবার লাগছিল এই পাশে। মূলত আমাদের এভাবে উচ্ছেদ করে যাদের টাকা আছে, তাদের ঘর করে দেওয়ার জন্যই আগুন লাগানো হচ্ছে।’

এবারের আগুনে উত্তর পাশে গড়ে ওঠা নতুন ঘরগুলোর ক্ষতি না হলেও বস্তির মধ্যভাগ ও দক্ষিণ পাশের প্রায় সব ঘর পুড়ে গেছে। বুধবার (১১ মার্চ) সকাল পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের অব্যাহত চেষ্টায় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি হিসাবের জন্য চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। বস্তির মোট ঘর সংখ্যা ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঘরের সংখ্যা জানা না গেলেও স্থানীয় প্রতিনিধি ও বাসিন্দারা জানান, পাঁচ হাজারের বেশি ঘর ছিল রূপনগরের এই বস্তিতে, যার অধিকাংশই পুড়ে গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বস্তির মাঝামাঝি জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও পরে চারপাশে তা ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর বস্তির বাসিন্দারা যে যার মতো জিনিসপত্র সরিয়ে বাইরে নিয়ে এসেছেন। বস্তির ঘরগুলো থেকে উদ্ধার করা আসবাবপত্র রূপনগরের শিয়ালবাড়ি সড়ক, মিরপুর-৬ এর ‘টি’ ব্লকের সড়ক ও ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে এনে রেখেছেন বাসিন্দারা। তবে শ্রমজীবী এই মানুষদের অনেকে ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। আগুন লাগার আগে তারা কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বরে হয়েছিলেন। আগুনের খবরে যখন তারা ফিরে এসেছেন ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের ঘর।

পুড়ে যাওয়া বস্তিতে ঘর মালিকের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি কেউ। তবে স্থানীয় প্রশাসন ঘর মালিকদের তালিকা করছে। প্রতিটি ঘর আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় ভাড়া দিতো মালিকরা। ভোলার ইলিশ্যা এলাকায় নদী ভাঙনের কবলে পড়ে পাঁচ বছর আগে এই বস্তিতে আসেন রাবেয়ার বাবা-মা। তারা এই বস্তিতে ১০টি ঘরের মালিক। বাড়ি করার আগে এক নেতাকে ৪৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল বলে জানান রাবেয়া। তবে কাকে এই টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা জানাতে পারেননি তিনি।

বস্তিতে ২০টি ঘরের মালিক ইমন। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম এই বস্তিতে। গতবছর আগুন লাগার পর আমাদের মনে হয়েছিল—এই বস্তিতেও আগুন লাগিয়ে আমাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। আমরা বারবার প্রশাসনের কাছে গিয়েছি। বলেছি, আমাদের উচ্ছেদ করে দিলে বলে দেন। আমরা চলে যাবো। কিন্তু আমাদের আগুনে পুড়িয়ে নিঃস্ব করবেন না। যা ভাবছিলাম তাই হলো।’

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বলেন, ‘বস্তিবাসীর জন্য যত ধরনের সহযোগিতা দরকার আমরা করবো। সরকারি প্রশাসনের বাইরে আমাদের প্রত্যেক নেতাকর্মী বস্তিবাসীর পাশে থাকবে।’ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্থায়ী সমাধানের কথা বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ‘এটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সম্পত্তি। এখানে এখনও কোনও ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গৃহায়নের পক্ষ থেকে সংস্থাটির সদস্য (প্রকৌশল) এসএম ফজলুল কবীরকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের কারণসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *