চট্টগ্রাম: প্রবাসী ফয়সাল মাহমুদ। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চাকরির সুবাদে পরিবার পরিজন নিয়ে যেতে চান সে দেশে।
কিন্তু একমাস ধরে তার ছোট দুই সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করতে ২০ বারের অধিক ওয়ার্ড অফিসে গিয়েছেন তিনি। এরপরেও তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রস্তুত হয়নি।
প্রতিবারই কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে শুনতে হয়েছে ‘সার্ভার ডাউন’।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিম ষোলশহর ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের এ চিত্র।
শুধু এ ওয়ার্ডেই জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, তা নয়। নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে হাজারো জনসাধারণকে।
ফয়সাল মাহমুদ বলেন, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চাকরি করেছি। প্রতিবছর দেশে আসতে হয় আমাকে। যা উপার্জন করি তা পথেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তাদেরকেও সৌদি আরবে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু একমাস ধরে কমিশনার অফিসে আসি আর যাই। তাদের একটাই কথা- ‘সার্ভার ডাউন’। তবে, কমিশনার অফিসের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে কোন অবহেলা ছিল না। তারাও এ বিষয় নিয়ে বিরক্ত। শতবার চেষ্টা করেও সার্ভারে ঢুকতে পারছেন না তারা।
দেশিয় আইনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোষ্ঠী, বয়স নির্বিশেষে সবার জন্ম নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। দেশে জন্ম নেওয়া শিশুর প্রথম স্বীকৃতি এই জন্ম নিবন্ধন। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিককে দেওয়া হয় সনদ। সেই সনদ পেতে অধিকাংশ নাগরিককে পোহাতে হয় সীমাহীন ভোগান্তি।
জানা গেছে, ২০১০ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনলাইন করার পর থেকে সেবাপ্রাপ্তি সহজ ও নিরাপদ করতে সেবার উন্নতির নামে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে বেশ কয়েকবার। কার্যত স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইন করার পর বেড়েছে ভোগান্তি। ‘অনলাইন’ নাম হলেও নিবন্ধন সম্পন্ন করতে এখনও সরকারি কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয় সেবাপ্রার্থীদের।
মূলত নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক কঠিন করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ৷ এতে সার্ভার ডাউন, পসিবল ডুপ্লিকেট (সম্ভাব্য দুবার আবেদন), অনলাইন টাকা গ্রহণে ধীরগতি, ওটিপি সমস্যা, আবেদন ফরম প্রিন্টিংয়ের সুযোগ না থাকা, দিনে ত্রিশটির অধিক নিবন্ধন সম্পন্নের সুযোগ না থাকা, নিবন্ধন নম্বরের বিকল্প কী-ওয়ার্ড দিয়ে আবেদন খোঁজার সুযোগ না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে সেবাদাতারা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিম ষোলশহর এলাকার কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সার্ভার সংক্রান্ত নানা রকম সমস্যা নিয়ে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে জন্ম নিবন্ধন রেজিস্টার জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। লিখিতভাবে জানানোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আজ চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আমরা এ ভোগান্তির কথা তুলে ধরবো।
তিনি আরও বলেন, দেশে একই নামে একাধিক কেন, সহস্রাধিক ব্যক্তি থাকতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বাবা বা মায়ের নামও মিলে যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে নিবন্ধনের সময় পসিবল ডুপ্লিকেট আসে। আগে এটা জেলা প্রশাসন ঠিক করতে পারতো, এখন তাদের ওপরও নেই।
আবার প্রতিটি নিবন্ধনের জন্য আলাদা ওটিপির প্রয়োজন হয়। এটা ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো- প্রতিটা ওটিপির জন্য পৃথক ফোন নম্বর লাগে। এক্ষেত্রে একই পরিবারে যদি একাধিক শিশু থাকে, তাদের নিবন্ধনের সময় ঝামেলায় পড়তে হয়।
মোবারক আলী বলেন, ‘বিষয় হলো একটা ওয়ার্ড থেকে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০টি নিবন্ধন সম্পন্ন করার সুযোগ আছে। অথচ প্রতিদিন আমাদের সেবাপ্রার্থী এর কয়েকগুণ বেশি। এতে আমাদের জট লেগে যাচ্ছে। সেবাপ্রার্থীরা এসব বুঝতে চান না, আমাদের এটা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়’।
সিটি করপোরেশনের পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘অধিকাংশ সময় দেখা যায় পেমেন্ট গ্রহণ করতে অতিরিক্ত সময় নেয়। সার্ভার ডাউন থাকে। পেমেন্ট গ্রহণে সময় বেশি নেওয়ায় আমাদের কাছে সেবা প্রার্থীরা আসলেও পেমেন্ট অসম্পন্ন দেখায়। তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়। এসব সমস্যার কারণে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে’।
চসিকের উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, ‘সার্ভার ডাউন সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিছুদিন আগেও দিনের অধিকাংশ সময় সার্ভার ডাউন থাকতো। এখন অবশ্য কমেছে। আবার অনেক সময় কেউ জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে ফেললে তার তো আর নিবন্ধন নম্বর মনে থাকবে না৷ কিন্তু সার্ভারে কারো নিবন্ধন খোঁজার জন্য নিবন্ধন নম্বরই ব্যবহার করতে হয়। এক্ষেত্রে কেউ নিবন্ধন সনদ হারিয়ে ফেললে সেটার কোনো সমাধান পাওয়া যায় না’।
স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি৷