শিশুর ডেলিভারি কি উপায়ে হবে?

“শিশুর ডেলিভারি কি উপায়ে হবে?

নরমাল নাকি সিজারিয়ান!”

সকল নারীকেই জীবনে কখনো না কখনো মা হবার স্বাদ নিতে হয়। তাহলে খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, মা হবার জন্য বেবি ডেলিভারির ধরন কেমন হওয়া উচিত?
আবহমান কাল ধরে যেভাবে হয়ে আসছে, এখন সেরকম হচ্ছে না কেনো?
আমরা কি অনেক বেশি অসহিষ্ণু, যান্ত্রিক, অস্থির, ভীতু, কিংবা অগাধ পণ্ডিত হয়ে যাচ্ছি?
নাকি অসাধু কিছু ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল ব্যবসায়ীরা আমাদের স্বাভাবিক ডেলিভারি প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছেন?

অসংখ্য মতামত, ধারনা, ভুল ধারনা, শোনা কথা, ভয়ভীতি, জ্ঞান গরিমা, তর্ক-বিতর্ক এসবের যেন কোন শেষ নেই!
আধুনিকায়নের এই দুনিয়ায় কাকে বিশ্বাস করবো আর কোথায় রাখবো ভরসা?

আসুন তাহলে জেনে নেই,
সঠিক কিছু তথ্য যা আমাদের অনেক ভুল/না জানাকে সম্পূর্ণ করবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করবে।

প্রথম কথা,

যে যুগে যন্ত্র, সুই, কাঁচি, ছুড়ি ছিলো না…
এমনকি সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন ডাক্তার’ও ছিলোনা,
সে যুগেও বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হতো এবং আজো হয়!
কারন, উপর’ওয়ালা শিশুর জন্মের জন্য মায়ের শরীরে এই ব্যবস্থা স্বাভাবিক উপায়ে করে রেখেছেন।
তাই, একজন স্বাভাবিক সুস্থ মা ও গর্ভস্থ সুস্থ শিশুর জন্য নরমাল ডেলিভারি হলো প্রথম উপায়।

কিন্তু, কেনো তাহলে ছুড়ি, কাঁচি, যন্ত্র, অপারেশন এর দরকার??
জেনে নেবো আমরা কি কি সেই সব জরুরি অবস্থা, যেসব কারনে সুস্থ মা ও সন্তানের জীবন রক্ষার্থে সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারির প্রয়োজন হয় —

>>Absolute Indications of Caesarean Delivery (অবশ্য জরুরী কারণ)

১। গর্ভফুল জরায়ু মুখের সামনে অবস্থান করা এবং প্রসবপূর্ব রক্তপাত (APH due to Central Placenta Previa)
২। সরু/চাপা কোমরের হাড় (Contracted Pelvis)
৩। গর্ভপথ ও কোমরের অসামঞ্জস্যতা (Cephalo-Pelvic Disproportion)
৪। তলপেটে বড় টিউমার (Pelvic Mass)
৫। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জটিল অবস্থা (Advanced Carcinoma Cervix)
৬। সরু, চাপা যোনিপথ (Vaginal Obstruction)
৭। মায়ের উচ্চতা ৪’১০” এর কম (এক্ষেত্রে বেবি ডেলিভারির সময় মাথা আটকে শিশু মৃত্যু ঝুঁকি বেশি)

এসব ক্ষেত্রে ‘মা-বাপ’ বলে পায়ে ধরলেও নরমাল ডেলিভারি করিয়ে মা ও শিশুর সুস্থতা আশা করা যাবেনা!

>>অন্যান্য কারণ

১। পূর্বের সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারি।
২। বাচ্চা জরায়ুর মাঝে কষ্টে থাকা, অক্সিজেন কম পাওয়া, নড়াচড়া কম, পায়খানা করে দেয়া (Fetal Distress)
৩। সময়ের বহু আগে জরায়ুর ভেতরের তরলের থলি ভেঙ্গে যাওয়া ও প্রসব ব্যাথা না ওঠা (Pre term/Term PROM)
৪। জরায়ুর মাঝে পানি বেশি মাত্রায় কমে গিয়ে বাচ্চা শুকনাতে পড়ে যাওয়া (Oligohydramnios)
৫। বাচ্চা সঠিক পজিশনে না থাকা (হাত, পা, মুখ, কাধ, পুচ্ছদেশ ইত্যাদি জরায়ুর সামনের দিকে থাকা)
সঠিক পজিশন হলো, বেবির মাথা জরায়ুর মুখের দিকে থাকবে।(Malpresentation)
৬। ১২-১৮ ঘন্টার বেশি সময় ধরে প্রসব ব্যাথা থাকা কিন্তু সে তুলনায় প্রসব হবার সম্ভাবনা না দেখা দেওয়া।
(Prolonged Labour)
৭। কোনো কারনে বাচ্চার কোনো অংগ গর্ভপথের কোথায় আটকে যাওয়া (Obstructed Labour)
৮। মায়ের পূর্বে ২ বা এর অধিক এবরশন, মৃত শিশু জন্ম ইত্যাদির ইতিহাস থাকা (Bad Obstetric History)
৯। ডেলিভারি ডেট পার হয়ে গেসে, আর্টিফিশিয়াল ব্যাথা ওঠানোর চেষ্টা করে হয়েছে, তবু কিছু হচ্ছে না। (Post Dated Pregnany with Failed Trial)
১০। মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, হারট ডিজিজ ইত্যাদি থাকা ও এর কারনে জটিলতা বৃদ্ধি।
১১। মায়ের খিঁচুনি, এজমা ইত্যাদি এটাকের সম্ভাবনা।

উপরের শেষ দুটি কারন ছাড়া বাকি সব কারনেই ‘যথেস্ট রিস্ক নিয়ে’ মায়ের নরমাল ডেলিভারি করানো যেতে পারে (উন্নত দেশে করানো হয়)।
তবে, এইসব রিস্ক মা কিম্বা বাচ্চার জন্য আমাদের দেশে একটি পরিবার’ও নিতে রাজি হয়না বরং মা/বাচ্চার যেকোনো জটিলতায় মৃত্যু হলে ‘ডাক্তার’কে দোষারোপ, ভুল বোঝা ও অবহেলাকে দায়ী করে’ ক্ষমতা, টাকা ইত্যাদির দাপট দেখানো হয়।
ডাক্তারের সিদ্ধান্তকে অসম্মান, অপমান ও অবুঝের মতো বাস্তব বিবরজিত অসদাচরন করা হয়।
যা খুব’ই দুঃখজনক।

উল্লেখ্য ৫,৬,৭ নাম্বার পয়েন্টের জন্য উন্নত দেশে ‘ফরসেপ্স কিম্বা ভ্যাকুয়াম ডেলিভারি’ করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যথারীতি ‘বেবির রিস্ক বিবেচনায়’ এই পদ্ধতি এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে!

>>শেষ কারণ

১। মায়ের অস্থিরতা (আর কতো ব্যাথা সহ্য করবো, আর পারছি না, প্লিজ বাচ্চা বের করে দেন, আমি মরে যাবো) Maternal Distress.

২। পরিবার ও স্বজনদের অস্থিরতা (এতো সময় লাগবে! আমার তো এতো সময় লাগে নাই! প্লিজ কিছু করেন, আমার মেয়ে তো আর পারছে না! আমরা নিজ ইচ্ছায় সিজারিয়ান চাই!) Patient Party Distress.

বলা বাহুল্য, উপরের দুটি পয়েন্টের একটিও প্রয়োজনীয় কারন নয় সিজারিয়ানের। উন্নত কোনো দেশে এইসব কারন উচ্চারন করার কেউ দুঃসাহস করবে না! কারন সেসব দেশে ক্ষমতা, টাকার দাপট, ডাক্তারের সিদ্ধান্তের উপর অকারন মাতব্বরি করবার ধৃষ্টতা কেউ দেখায় না! এবং আমাদের দেশে এই দুটি কারনে সবচাইতে বেশি সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়! (প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলির মূল ব্যবসা)। ভুক্তভোগী হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের কম বোঝা, কম শিক্ষিত, কম বুঝদার সাধারণ মানুষেরা। শহুরে কিংবা গ্রাম্য দালাল, গ্রাম্য অশিক্ষিত কোয়াক, দাই, আয়া, নার্স, হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিরা কমিশন এর বিনিময়ে হাসপাতালগুলোতে এসব সাধারণ রোগী এনে প্রতারিত করে। সবকিছুর মাঝে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয় “ডাক্তার ও রোগীর মাঝে”। এতে সঠিক কারনে সিজারিয়ান করতে ভরসা পায় না রোগী। অথচ বিনা কারনে ক্লিনিক ব্যবসা হয় জমজমাট।

শেষ কথা,
সঠিক জ্ঞান ও বিবেচনাবোধ আপনাকে বাচাঁতে পারে প্রতারণা থেকে। বাচাঁতে পারে আপনার শিশুর প্রাণ।
সুস্থ মা ও শিশু ডেলিভারির ভার আমাদের পরিবারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও বিচারবোধের উপরেই নির্ভর করে।

কোনো নীতিবান, সৎ, জ্ঞানী ডাক্তার কখনো যেমন অকারন, অন্যায্য সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারি করান না, ঠিক তেমনি মা ও শিশুর সুস্থতায় প্রয়োজনীয় জরুরি সিজারিয়ান এর সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হন না।

সঠিক ডাক্তার খুজে নিন।
সঠিক সিদ্ধান্ত বুঝে নিন।
পরিবার, সন্তান আপনার, বিবেচনা-ফলাফল এর দায় ও আপনার!
সবাই সুস্থ থাকুন।

লিখেছেনঃ
✍ ডাঃ আয়েশা রাইসুল
(গভঃ রেজিঃ H-১৫৯৮)
বি.এইচ.এম.এস (ঢাঃ বিঃ)
এক্স-হাউজ ফিজিসিয়ান,
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *